রোগ সারাতে পারছে না অনেক অ্যান্টিবায়োটিক

সড়ক দুর্ঘটনায় আহত যশোরের সুরুজ মিয়ার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে জটিল পরিস্থিতিতে পড়েন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসকেরা। গত ২৬ জুন দুর্ঘটনার পর প্রথমে তাঁর চিকিৎসা হয় বেসরকারি হাসপাতালে। ৫ জুলাই তাঁকে বিএসএমএমইউতে আনা হয়। এখানে পরীক্ষা করে দেখা যায়, একটি মাত্র অ্যান্টিবায়োটিক তাঁর শরীরে কাজ করছিল, কিন্তু তা কিডনির ক্ষতি করে।

বাংলাদেশে তীব্র শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ, ডায়রিয়া-জনিত রোগ, যক্ষ্মা, মূত্রতন্ত্রের সংক্রমণ, কানের রোগ, টাইফয়েড, ত্বকের সংক্রমণ, কালাজ্বর, ম্যালেরিয়া, গনোরিয়া, সিফিলিসের চিকিৎসায় বেশ কিছু অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর হয়ে পড়েছে। সরকারের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা, ঔষধ প্রশাসন, আইসিডিডিআরবি, গ্লোবাল অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্স ও দ্য সেন্টার ফর ডিজিজ ডিনামিক্স, ইকোনমিকস অ্যান্ড পলিসির যৌথ প্রতিবেদনে এ তথ্য দেওয়া হয়েছে। গত জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে অর্ধেকের বেশি অ্যান্টিবায়োটিক ভুলভাবে ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়। অযৌক্তিক ও যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণে অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকারিতা হারাচ্ছে। এতে রোগ নিরাময়ে সময় বেশি লাগছে, রোগীর খরচও বাড়ছে।

সুরুজ মিয়ার মাথাসহ বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ জখম হয়েছিল। বিএসএমএমইউতে ভর্তির পর কণ্ঠনালির লালা পরীক্ষা (ড্রাগ সেনসিভিটি টেস্ট) করা হয়। প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা প্রতিবেদনে দেখা যায়, ১৩টি অ্যান্টিবায়োটিকের নামের পাশে ‘আর’ (রেজিস্ট্যান্স) লেখা। শুধু কোলিস্টিন সালফেট নামের অ্যান্টিবায়োটিকের পাশে ‘এস’ (সেনসিটিভ) লেখা।

১৯ জুলাই বিএসএমএমইউর নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মো. সাকিবুর রহমান প্রথম আলোকে ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন, ‘সুরুজ মিয়ার চিকিৎসায় ১৪ ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের সুযোগ ছিল। এখন কোলিস্টিন সালফেট ছাড়া আমাদের হাতে কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু ওষুধটি কিডনির ক্ষতি করছে। দামও অনেক বেশি।’

গত ১১ আগস্ট বিএসএমএমইউর আইসিইউতে গিয়ে দেখা যায়, সুরুজ মিয়া যে বেডে ছিলেন, সেখানে আছেন সন্ধ্যা রানী। সুরুজ মিয়া ২০ জুলাই মারা গেছেন। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের পর ৩১ জুলাই সন্ধ্যা রানীকে এখানে আনা হয়। কাগজপত্রে দেখা যায়, সন্ধ্যা রানীর চিকিৎসায় ১৬টি অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের সুযোগ ছিল। কিন্তু পরীক্ষায় ১২টিই অকার্যকর শনাক্ত হয়েছে।

বিএসএমএমইউর অ্যানেসথেসিয়া, অ্যানালজেসিয়া অ্যান্ড ইনটেনসিভ কেয়ার মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম আখতারুজ্জামান গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেক হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে পরে মানুষ বিএসএমএমইউর আইসিইউতে আসে কম খরচে উন্নত চিকিৎসার আশায়। কিন্তু তত দিনে অনেক জটিলতা দেখা দেয়। আমাদের হাতে বিকল্প থাকে কম।’

বিএসএমএমইউর ফার্মাকোলজি বিভাগের অধ্যাপক সাইদুর রহমান দীর্ঘদিন ধরে অ্যান্টিবায়োটিক নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। তবে আতঙ্কিত না হয়ে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে সতর্ক ও সংযমী হতে হবে। এ ক্ষেত্রে বৈশ্বিক নির্দেশনা মেনে চলা দরকার।

দেশের প্রায় দুই লাখ ওষুধের দোকান থেকে যে কেউ ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই অ্যান্টিবায়োটিক কিনতে পারেন। অসংখ্য চিকিৎসক সামান্য অসুখে অ্যান্টিবায়োটিক দেন। প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে বিনা মূল্যে তিন ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়। এ ছাড়া ব্যবস্থাপত্রে লেখা অ্যান্টিবায়োটিক কেনা ও ব্যবহারের সময় নানা ভুল হয়। এই কারণগুলো অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স তৈরি করছে।

অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতিতে ব্যাকটেরিয়ার বেঁচে থাকার ও বংশবিস্তার করার ক্ষমতা অর্জনই অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স বা প্রতিরোধ। একে ওষুধ প্রতিরোধও বলা হয়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, কিছু জীবাণুর সহজাত ক্ষমতা আছে ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে ওঠার। আবার কিছু জীবাণু নিজেরা রূপান্তরিত হয়ে যায়। কিছু জীবাণু নিজেদের কোষ থেকে ওষুধ বের করে দিতে পারে।

শ্বাসতন্ত্রের রোগ
বাংলাদেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী ২২ শতাংশ শিশু ও ১৩ শতাংশ নবজাতক মারা যায় তীব্র শ্বাসতন্ত্রের রোগে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি শিশু মারা যায় নিউমোনিয়ায়। চিকিৎসকেরা দেখেছেন, নিউমোনিয়া চিকিৎসায় কিছু অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করছে না।

বিভিন্ন গবেষণার উপাত্ত উদ্ধৃত করে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাইপেরাসিলিন নামের অ্যান্টিবায়োটিক ১০০ শতাংশ অকার্যকর হয়ে পড়েছে। অ্যামোক্সোসিলিন ৮৯ ও কোট্রিমোক্সাজোল ৮১ শতাংশ ক্ষেত্রে অকার্যকর। শ্বাসতন্ত্রের কিছু রোগে অ্যাজিথ্রোমাইসিন (২৭ %), সিপ্রোফ্লক্সাসিন (৩২ %), সেফট্রায়াক্সোনসহ (৫৬ %) ১৫টি অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর হয়ে পড়েছে।

শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের সাবেক প্রধান অধ্যাপক আবিদ হোসেন মোল্লা প্রথম আলোকে বলেন, ‘একসময় নিউমোনিয়া চিকিৎসায় আমরা কোট্রিমোক্সাজোল ব্যবহার করতাম। এখন করি না। কারণ, এই ওষুধে রোগ নিরাময় হয় না। নিউমোনিয়ার জীবাণু কোট্রিমোক্সাজোল প্রতিরোধে সক্ষম।’

ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা বাড়ছে
সাধারণ যক্ষ্মার রোগীকে নিয়মিত সঠিক মাত্রায় ওষুধ না খাওয়ালে এবং ওষুধের কোর্স পূর্ণ না করলে যক্ষ্মার জীবাণু ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে ওঠে। একে বলে ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা বা মাল্টিড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টিবি (এমডিআরটিবি)। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এমডিআরটিবির প্রকোপ বেশি, এমন দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম অন্তর্ভুক্ত করেছে।

সাধারণ যক্ষ্মা রোগীর চিকিৎসা হয় ছয় মাসের। এমডিআরটিবি রোগীর চিকিৎসায় লাগে ২৪ মাস (সম্প্রতি একটি পদ্ধতিতে নয় মাসে চিকিৎসা হচ্ছে)। সরকারি ব্যবস্থায়ই সাধারণ যক্ষ্মা রোগীর তুলনায় এমডিআরটিবি রোগীর চিকিৎসা ব্যয় চার গুণ বেশি।

মূত্রতন্ত্রের সংক্রমণ
মূত্রতন্ত্রের সংক্রমণ প্রধানত ই-কোলাই নামের ব্যাকটেরিয়ার কারণে হয়ে থাকে। এই সংক্রমণ নারীর বেশি হয়। এই সংক্রমণ মূত্রতন্ত্রের ওপরের দিকে ঘটলে তাকে কিডনির সংক্রমণও বলা হয়। পাকস্থলী ও অন্ত্রের ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ প্রদাহের ক্ষেত্রে ই-কোলাইকে দায়ী করা হয়। তবে আরও কিছু ব্যাকটেরিয়ার কারণে শরীরের এসব অঙ্গে সংক্রমণ দেখা দিতে পারে।

মূত্রতন্ত্র, কিডনি, পাকস্থলী ও অন্ত্রের প্রদাহের চিকিৎসার শুরুতেই অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের পরামর্শ দেন চিকিৎসকেরা। মূত্রতন্ত্রের চিকিৎসায় ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর হওয়ার ঘটনা সাধারণ হয়ে পড়েছে। যৌথ প্রতিবেদন বলছে, এই প্রবণতা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, নারীদের শরীরে থাকা ই-কোলাই ৮৯ শতাংশ ক্ষেত্রে সিপ্রোফ্লক্সাসিন প্রতিরোধী। আরও পাঁচটি অ্যান্টিবায়োটিক ৫০ শতাংশের বেশি ক্ষেত্রে অকার্যকর। শিশুদের ক্ষেত্রে এম্পিসিলিন ৯৫ শতাংশ অকার্যকর। শিশুদের মূত্রতন্ত্রের চিকিৎসায় আরও চারটি প্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিক ৬৬ শতাংশের বেশি ক্ষেত্রে অকার্যকর দেখা গেছে।

টাইফয়েড
অভিজ্ঞ চিকিৎসকই সহজে টাইফয়েড শনাক্ত করতে পারেন। কিন্তু দীর্ঘদিন টাইফয়েডের ভুল চিকিৎসায় বা ভুল অ্যান্টিবায়োটিকের কারণে এর জীবাণুটি ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে। টাইফয়েড চিকিৎসার প্রথম সারির তিনটি অ্যান্টিবায়োটিক বাংলাদেশে ৪০ শতাংশ ক্ষেত্রে অকার্যকর হয়ে পড়েছে।

এভাবে নবজাতকের সংক্রমণে, ত্বকের অসুখে, কানের রোগের জন্য দায়ী ব্যাকটেরিয়াগুলো ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে উঠছে। অন্যদিকে কালাজ্বরের মতো কীটবাহিত রোগ বা গনোরিয়া-সিফিলিসের মতো যৌন রোগের ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা কমে যাচ্ছে। যৌথ প্রতিবেদনে প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিরোধী হওয়া অ্যান্টিবায়োটিকের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।

অনেক ক্ষেত্রে সুস্থ মানুষও হাসপাতাল থেকে ওষুধ প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হয়। এ ঘটনা বেশি ঘটে হাসপাতালগুলোর নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে।

পরিণতি
অধ্যাপক সাইদুর রহমান বলেন, প্রায় প্রতিটি সংক্রামক রোগের ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিকের বিকল্পের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। কোনো অ্যান্টিবায়োটিকে নিরাময় না হলে রোগীকে অন্য আর একটি দেওয়া হচ্ছে। এতে রেজিস্ট্যান্সের বিস্তার ঘটছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমিত হিসাব বলছে, অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের কারণে প্রতিবছর বিশ্বে সাত লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। ২০৫০ সাল নাগাদ তা ১০ লাখে পৌঁছাবে। যৌথ প্রতিবেদনে বাংলাদেশের মৃত্যুর সঠিক কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও তাতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়।

করণীয়
অধ্যাপক সাইদুর রহমান বলেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে চিকিৎসকসহ অন্যান্য সেবা প্রদানকারী ও রোগীদের সতর্ক হতে হবে। অপ্রয়োজনে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা যাবে না। রোগীকে চিকিৎসকের পরামর্শ যথাযথভাবে মানতে হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাসপাতালের অস্ত্রোপচারকক্ষে বা তার পরবর্তী ধাপে রোগী যেন সংক্রমিত না হয়, সে জন্য জীবাণুনাশক বা অটোক্লেভ ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। অন্যদিকে সাধারণ মানুষ ঘরে বা কর্মস্থলে যদি নিয়মিত হাত ধোয়ার অভ্যাস করে, তবে সংক্রমণ বহুলাংশে কমে যাবে।

প্রতিটি জেলায় অ্যান্টিবায়োটিকের সংবেদনশীলতা পরীক্ষার জন্য মানসম্পন্ন পরীক্ষাগার গড়ে তুলতে হবে। এটা করে সম্ভব হলে আন্দাজে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করার পরামর্শ দেওয়ার প্রবণতা কমবে।

এ ব্যাপারে সরকার কী করছে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রামক রোগনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির পরিচালক অধ্যাপক সানিয়া তাহমিনা প্রথম আলোকে বলেন, অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ পরিস্থিতি পর্যালোচনা শেষ হয়েছে। জাতীয় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে কৌশলপত্র ও কর্মপরিকল্পনাও চূড়ান্ত করা হয়েছে। এখন অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের নির্দেশিকা তৈরির কাজ চলছে। পাশাপাশি চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হচ্ছে।

সূত্র- প্রথম আলো  ৯সেপ্টেম্বার ২০১৮ ইং

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *