অটিজম কি? লক্ষণ ও তার প্রতিকার এবং হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা।

অটিজম কি?
অটিজম একটি মানসিক বিকাশ ঘটিত সমস্যা যা স্নায়ু বা স্নায়ুতন্ত্রের গঠন ও পরিবর্ধন জনিত অস্বাভাবিকতার ফলে হয়। অটিজমে আক্রান্ত শিশুর স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে অসুবিধা হয়। অটিজমের কারণে কথাবার্তা, অঙ্গভঙ্গি ও আচরণ একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে আবদ্ধ থাকে আবার অনেকক্ষেত্রে শিশুর মানসিক ও ভাষার উপর দক্ষতা কম থাকে। সাধারনত ১৮ মাস থেকে ৩ বছর সময়ের মধ্যেই এই রোগের লক্ষণগুলো দেখা যায়।
অটিজমে আক্রান্ত একটি শিশুর কিছু আচরণগত সমস্যা লক্ষ্য করা যায়, যেমন- সে সামাজিকভাবে মেলামেশা করতে পারে না। শুধু কথা না বলা অটিজমের মধ্যে পড়ে না। তার সাথে তার অন্যান্য আচরণ, সামাজিকতা, অন্য একটি শিশুর সাথে অথবা বয়স্ক মানুষের সাথে মেশার বিষয়ে গণ্ডগোল থাকলে ধরে নিতে হবে শিশুটি অটিজমে আক্রান্ত হতে পারে।
অটিজমে আক্রান্ত শিশু কথা বলতেও পারে আবার একদম নাও বলতে পারে। আবার কথা বললেও হয়তো ঠিকমতো গুছিয়ে বলতে পারে না। আবার একজন সুস্থ মানুষ যেভাবে কথা বলে সেভাবে নাও বলতে পারে। অর্থাত্‍, সে হয়ত কথা বলতে পারে কিন্তু সুন্দরভাবে গুছিয়ে বলতে পারে না। এক্ষেত্রেও শিশুটি অটিজমে আক্রান্ত হতে পারে।

অটিজম কেন হয়?
অটিজমের নির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই। পরিবেশগত ও বংশগত কারণেও এই রোগ হতে পারে। সাধারণত জটিলতা, লক্ষণ অথবা তীব্রতার উপর নির্ভর করে এর কারণগুলো বিভিন্ন হতে পারে। কি কি কারনে অটিজম হতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে সতর্ক হলে অটিজম প্রতিরোধ সম্ভব হতে পারে।
চিকিত্‍সকদের মতে, ভাইরাল ইনফেকশন, গর্ভকালীন জটিলতা এবং বায়ু দূষণকারী উপাদানসমূহ স্পেক্ট্রাম ডিজঅর্ডার হওয়ার ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা রাখে। বিভিন্ন জীনের কারণে অটিজম স্পেক্ট্রাম ডিজঅর্ডার হতে পারে। আবার কোন কোন শিশুর ক্ষেত্রে জেনেটিক ডিজঅর্ডার যেমন- রেট সিন্ড্রোম বা ফ্র্যাজাইল এক্স সিন্ড্রোমের সাথে এই রোগটি হতে পারে। কিছু জীন মস্তিষ্কের কোষসমূহের পরিবহন ব্যবস্থায় বাধা প্রদান করে এবং রোগের তীব্রতা বৃদ্ধি করে। জেনেটিক বা জীনগত সমস্যা বংশগতও হতে পারে আবার নির্দিষ্ট কোনো কারণ ছাড়াই এই রোগটি হতে পারে। ভ্যাকসিন বা প্রতিষেধকের সাথে অটিজমের কোনও সম্পর্ক পাওয়া যায়নি।

অটিজমের লক্ষণঃ

অটিজমের লক্ষণগুলো সঠিকভাবে জানার মাধ্যমে অটিজম বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে সাধারণত যে লক্ষণগুলো দেখতে পাওয়া যায় সেগুলো হলঃ
অটিস্টিক শিশুদের ঘুম সম্পর্কিত কিছু সমস্যা থাকে। ঘুম স্বাভাবিক না হওয়ার কারণে তাদের মনোযোগ ও কাজের সক্ষমতা কমে যায় এবং আচার আচরণে সেটা পরিস্কার বোঝা যায়।
অনেক শিশুর সঠিক সময়ে কথা বলতে সমস্যা হয়। মুলত ১৮ মাস থেকে ২ বছর সময়ের মধ্যে এটা বোঝা যায়।
অনেক অটিস্টিক শিশুর মাঝে অল্প মাত্রায় হলেও বুদ্ধি প্রতিবন্ধীতা লক্ষ্য করা যায়।
অনেক শিশুর শারীরিক বৃদ্ধি সঠিকভাবে হয় না।
অটিজমে আক্রান্ত অনেক শিশু দেখা, শোনা, গন্ধ, স্বাদ অথবা স্পর্শের প্রতি অতি সংবেদনশীল অথবা প্রতিক্রিয়াহীন থাকতে পারে।
সাধারণত অটিস্টিক শিশুদের প্রতি চারজনে একজনের খিঁচুনি সমস্যা হতে পারে।
অটিজম থাকা শিশুদের মানসিক অস্থিরতার ঝুঁকি বেশী থাকে। এসকল শিশুর বিষন্নতা, উদ্বিগ্নতা ও মনোযোগে ঘাটতিসহ বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে পারে।
অটিস্টিক শিশুদের প্রায়ই হজমের অসুবিধা, পেট ব্যথা, ডায়রিয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য, পেটের গ্যাস, বমি ইত্যাদি হতে পারে।

অটিজমের প্রধান লক্ষণঃ

১. ছয় মাস বা তার বেশি বয়সে স্বতঃস্ফূর্ত হাসি বা যে কোন আবেগ প্রকাশ করতে পারেনা।

২. ১২ মাস বয়সের মধ্যে আধো আধো কথা না বলা সেইসঙ্গে ইশারা বা হাত বাড়িয়ে কিছু চাইতে বা ধরতে পারেনা।।

৩. চোখে চোখ রেখে তাকাতে পারেনা।

৪. ভীড় এড়িয়ে একা থাকতে পছন্দ করে।

৫. অন্যের অনুভূতি বুঝতে পারেনা।

৬. একই নিয়মে চলতে পছন্দ করে। কোন পরিবর্তন এলেই বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখায়।

৭.একই শব্দ বারবার বলতে থাকে বা একই আচরণ বারবার করে যেমন: একইভাবে হাত বা মাথা নাড়ানো।

৮. বিশেষ রং, শব্দ, গন্ধ, স্পর্শ বা স্বাদের প্রতি কম বা বেশি মাত্রায় সংবেদনশীল হয়।

৯. কোন বিষয় বা বস্তুর প্রতি অতিমাত্রায় আগ্রহ দেখায়।

অটিজম এর চিকিত্‍সাঃ

কোনও শিশু অটিজমে আক্রান্ত মনে হলে অনতিবিলম্বে বিশেষজ্ঞ চিকিত্‍সকের বা হোমিওপ্যাথি রেজিস্টার্ড অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। প্রাথমিক অবস্থায় অটিজম নির্ণয় করতে পারলে এবং উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহন করলে অটিজম এর ক্ষতিকারক প্রতিক্রিয়াগুলো অনেক সফলভাবে মোকাবেলা করা যায়। শিশুর কি ধরনের অস্বাভাবিকতা আছে সেটা সঠিকভাবে নির্ণয় করে, অভিজ্ঞ হোমিওপ্যাথি রেজিস্টার্ড চিকিৎসক হোমিওপ্যাথি মতে রোগীলিপি তৈরি করে নির্দিষ্ট হোমিওপ্যাথি মাযাজম নির্ধারণ করে শারীরিক ও মানসিক লক্ষণ নির্ণয় করে সুনির্বাচিত হোমিওপ্যাথি ঔষধ প্রয়োগে চিকিত্‍সা করলে ভাল ফল পাওয়া যাবে।

এই ধরনের শিশুদের জন্য প্রচুর বিশেষায়িত স্কুল আছে, সেখানে তাদের বিশেষভাবে পাঠদান করা হয়। এ ধরনের স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে একজন অকুপেশনাল থেরাপিষ্টের পরামর্শ নিতে হবে। তিনি পরামর্শ দেবেন, কোন ধরনের স্কুল আপনার শিশুর জন্য উপযুক্ত হবে।
অনেক অটিস্টিক শিশুর কিছু মানসিক সমস্যা যেমন- অতিরিক্ত চঞ্চলতা, অতিরিক্ত ভীতি, ঘুমের সমস্যা, মনোযোগের সমস্যা ইত্যাদি থাকতে পারে। অনেক সময় এরকম ক্ষেত্রে, চিকিত্‍সক শিশুটিকে ঔষধ দিতে পারেন। এ বিষয়ে অসংখ্য লক্ষণ ভিত্তিক হোমিওপ্যাথি ঔষধ আছে।
নিবিড় ব্যবহারিক পরিচর্যা, স্কুল ভিত্তিক প্রশিক্ষণ, সঠিক স্বাস্থ্য সেবা এবং প্রয়োজনে সঠিক ওষুধের ব্যবহার একটি শিশুর অটিজমের সমস্যা নিয়ন্ত্রনে আনতে অনেকখানি সহায়ক হয়। যথাযথ সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে অটিস্টিক শিশুদের সঠিক ভাবে বেড়ে ওঠা নিশ্চিত করতে হবে।

অটিজম প্রতিরোধে করণীয় কি?

সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমেই এটি প্রতিরোধ করতে হবে। পরিবারে কারো অটিজম অথবা কোন মানসিক এবং আচরণগত সমস্যা থাকলে, পরবর্তী সন্তানের ক্ষেত্রে অটিজমের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। এক্ষেত্রে পরিকল্পিত গর্ভধারণ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। গর্ভাবস্থায় অধিক দুশ্চিন্তা না করা, পর্যাপ্ত ঘুম, শিশুর সাথে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন ইত্যাদি ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। আরও কিছু বিষয় খেয়াল রাখতে হবে।
যেমন-
বেশি বয়সে বাচ্চা না নেওয়া।
বাচ্চা নেয়ার আগে মাকে রুবেলা ভেকসিন দিতে হবে।
গর্ভাবস্থায় চিকিত্‍সকের পরামর্শ ছাড়া কোন ঔষধ খাওয়া যাবে না।
মায়ের ধূমপান, মদ্যপানের মত কোন অভ্যাস বা মাদকাসক্ত থাকলে বাচ্চা নেয়ার আগে অবশ্যই তা ছেড়ে দিতে হবে। সন্তান বা বাচ্চা নিতে পিতারও ভূমিকা রয়েছে, এজন্য পিতাকেও উত্তেজক মাদকদ্রব্য, মদ্যপান, মাদকাসক্ত এড়িয়ে চলা দরকার।
বাচ্চাকে অবশ্যই মায়ের বুকের দুধ খাওয়াতে হবে।

পরিশেষঃ
সঠিক সময়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিলে, বিশেষ করে স্কুলশিক্ষা বা প্রশিক্ষণ দিয়ে সেইসঙ্গে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে পারলে আক্রান্তকে দক্ষ করে তোলা সম্ভব।

লেখক পরিচিতিঃ

ডা. মো. আব্দুস সালাম (শিপলু)।
ডিএইচএমএস (রাজশাহী হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল)
এমএসএস (এশিয়ান ইউনিভার্সিটি)

ডাক্তার চেম্বার ও বাসাঃ
ডা. আব্দুস সালাম হোমিওপ্যাথি হেলথ কেয়ার,
ডাক্তার বাড়ী, জগন্নাথ পাড়া, শেরপুর, বগুড়া, বাংলাদেশ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *