ভোজ্য তেলে ক্ষতিকর মাত্রায় অ্যাসিড

Tel

এসএম আলমগীর :
দেশের বাজারে ভোজ্য তেলের অর্ধেকের মধ্যে অম্লত্ব বা অ্যাসিডিটি বেশি পাওয়া গেছে। কিছু তেলে অম্লের পরিমাণ সহনীয় মাত্রার চেয়ে এত বেশি যে, তা ব্যবহার করা তেলের নামে ‘বিষ’ খাওয়ার সমতুল্য।
সরকারের খাদ্য নিরাপত্তা পরীক্ষাগারে নমুনা পরীক্ষায় বাজারে বিক্রি হওয়া সয়াবিন, সরিষা, সূর্যমুখী, বাদাম ও তিলের তেলে মাত্রাতিরিক্ত অম্লত্ব পাওয়া গেছে। ধানের তুষ থেকে তৈরি রাইস ব্র্যান্ড অয়েল, জলপাই তেল বা অলিভঅয়েল ও পামঅয়েলে মাত্রাতিরিক্ত অ্যাসিড ভ্যালু দেখা যায়নি। রসায়ন শাস্ত্রে বৈজ্ঞানিক পন্থায় অ্যাসিডের উপস্থিতি পরিমাপ করে অ্যাসিড ভ্যালু নিরূপণ করা হয়।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা জানান, ভেজাল দিলে, দুই প্রকার তেল মিশ্রণ করলে, খাদ্য সংরক্ষণের মানসম্পন্ন পাত্রে (ফুড গ্রেড কনটেইনার) না রাখলে এবং বেশিদিন সংরক্ষণ করলে ভোজ্য তেলে অম্লের পরিমাণ ক্ষতিকর মাত্রায় বেড়ে যায়। আমাদের দেশে বেশি মুনাফার লোভে সয়াবিনের সঙ্গে পামঅয়েল অহরহ মেশানো হচ্ছে। বিশুদ্ধ পামঅয়েল খারাপ নয় বরং ভালো, কিন্তু মিশ্রিত পামঅয়েল ক্ষতিকর।
অ্যাসিড ভ্যালু গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি হলে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয়, বিশেষত যকৃত্ ও কিডনি রোগ, এমনকি ক্যানসারেরও আশঙ্কা রয়েছে। ভোক্তারা যেসব ভোজ্য তেল ব্যবহার করছেন তা কতটা নিরাপদ সে বিষয়ে ফুড সেফটি ল্যাবরেটরিতে সম্প্রতি বড় ধরনের একটি পরীক্ষা চালানো হয়। মহাখালীতে অবস্থিত এই গবেষণাগারটি জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধীনে এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (ফাও) অর্থায়নে পরিচালিত।
পরীক্ষার জন্য বাজার থেকে পরিচিত ব্র্যান্ড (প্রখ্যাত কোম্পানির চিহ্নযুক্ত) ও ব্র্যান্ড ছাড়া সয়াবিন, সরিষা, পামঅয়েল, বাদাম তেল, তিলের তেল, রাইস ব্র্যান্ড অয়েল, অলিভঅয়েল ও সূর্যমুখী তেলের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। প্যাকেটজাত ও খোলা ৭৩টি নমুনা নেওয়া হয়। গবেষণার ফলে দেখা যায়, ৭৩টির মধ্যে ৩৪টি নমুনায়, অর্থাত্ ৪৭ শতাংশ নমুনা তেলে অ্যাসিড ভ্যালু মাত্রাতিরিক্ত।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক ও ফুড সেফটি ল্যাবরেটরির শীর্ষ উপদেষ্টা প্রফেসর শাহ মনির হোসেন সকালের খবরকে বলেন, সাধারণত একটি তেলের সঙ্গে অন্য একটি তেলের মিশ্রণ ঘটলেই তাতে অ্যাসিড ভ্যালুর উপস্থিতির মাত্রা বেড়ে যায়। বাজারে যেসব সয়াবিন তেল পাওয়া যায় সেগুলোর সিংহভাগেই পামঅয়েল মেশানো। আর এ কারণেই ভোজ্য তেলে বেশি ভেজাল হচ্ছে। ভেজাল রোধ করা বা যারা ভেজাল তেল বিক্রি করছে তাদের ধরার দায়িত্ব বিএসটিআইর। কিন্তু সংস্থাটি সঠিকভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করছে না। সেটি করলে বাজারের প্রায় ৫০ শতাংশ ভোজ্য তেলে ভেজাল হতো না।
অবশ্য ভোজ্য তেল ব্যবসায়ীরা দাবি করেন, তারা এক তেলের সঙ্গে অন্য তেলের মিশ্রণ ঘটান না। ভোজ্য তেলে মাত্রাতিরিক্ত অ্যাসিড ভ্যালু থাকার বিষয়টিও তাদের জানা নেই বলে তারা জানান।
এ বিষয়ে ভোজ্য তেল আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান টি কে গ্রুপের হেড অব মার্কেটিং ফাইজুল্লাহ সকালের খবরকে বলেন, ভোজ্য তেলে আলাদা করে কেবল অ্যাসিড ভ্যালুর উল্লেখ প্রয়োজনীয় নয়। এতে আয়োডিন ভ্যালু সহনীয় মাত্রার বাইরে হতে পারে। এটা হলে ক্ষতির কারণ হতে পারত। তবে ভোজ্য তেলে মিশ্রণ হলে বা অশুদ্ধ তেল হলেও সেটা ক্ষতিকর হতে পারে।
কিন্তু তার এ বক্তব্যের সঙ্গে স্পষ্টতই দ্বিমত পোষণ করে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পাবলিক হেলথ ল্যাবরেটরির সিনিয়র মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট ড. মতিউর রহমান বলেন, অবশ্যই ভোজ্য তেলে অ্যাসিড ভ্যালুর মাত্রা উল্লেখ করা জরুরি।
পরীক্ষাগারে পরীক্ষার জন্য বাজার থেকে প্যাকেটজাত ১৩টি ব্র্যান্ডের সয়াবিন তেলের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে পাঁচটিতেই মিলেছে মাত্রাতিরিক্ত অ্যাসিড ভ্যালু উপাদান।
সয়াবিনে অম্লের সহনীয় মাত্রা হল দুই শতাংশ। অথচ পরীক্ষায় দেখা যায়, পাঁচটি ব্র্যান্ডের প্যাকেটজাত সয়াবিনে অ্যাসিড ভ্যালু প্রায় চার শতাংশ, অর্থাত্ সহনীয় মাত্রার দ্বিগুণ। খোলা সয়াবিনের দুটি নমুনা সংগ্রহ করে দেখা যায়, দুটিতেই অ্যাসিড ভ্যালু চার শতাংশ।
বোতলজাত বা প্যাকেটজাত সরিষার তেলের ১৯টি ব্র্যান্ডের নমুনা পরীক্ষা করে দেখা যায় ১৪টিতেই মাত্রাতিরিক্ত এসিডিটি রয়েছে। সরিষার তেলে অ্যাসিড ভ্যালু সহনীয় হল ১.২৫ শতাংশ। কিন্তু উপস্থিতি রয়েছে প্রায় চার শতাংশ। আর খোলা সরিষার তেলের পাঁচটি নমুনা পরীক্ষা করে দেখা যায় চারটিতেই রয়েছে মাত্রাতিরিক্ত এসিডিটি। এ ছাড়া সূর্যমুখী তেল, তিলের তেল ও বাদাম তেলেও মাত্রার চেয়ে বেশি অ্যাসিড ভ্যালু ধরা পড়েছে।
তবে মাত্রাতিরিক্ত এসিডিটি নেই অলিভঅয়েল, রাইস ব্র্যান্ড অয়েল ও পামওয়েলে। অলিভঅয়েলের একটি নমুনা পরীক্ষা করে দেখা যায় এতে সহনীয় মাত্রা দুই শতাংশের নিচেই রয়েছে অ্যাসিড ভ্যালু। রাইস ব্র্যান্ড অয়েলে একটি নমুনা পরীক্ষা করে দেখা যায় এতেও সহনীয় মাত্রা দুই শতাংশের নিচের রয়েছে অ্যাসিড ভ্যালু। আর পামঅয়েলের সহনীয় মাত্রা হল ০.২৮ শতাংশ। নমুনা পরীক্ষা করে দেখা যায়, এতে অ্যাসিড ভ্যালুর উপস্থিতি সহনীয় মাত্রার মধ্যেই রয়েছে।
এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পাবলিক হেলথ ল্যাবরেটরির সিনিয়র মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট ড. মতিউর রহমান বলেন, এসব তেলে দুটি তেলের মিশ্রণ করা হচ্ছে অথবা যে পাত্রে করে এটাকে সরবরাহ করা হচ্ছে কিংবা বাজারজাত করা হচ্ছে, সেই পাত্র ফুড গ্রেডের নয়। এ ছাড়া দীর্ঘদিন তেল সংরক্ষণ করে রাখা হলে সেখানে অ্যাসিড ভ্যালু বেড়ে যায়। এই ভোজ্য তেল মানুষ খেলে নানা রকম জটিল রোগে আক্রান্ত হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক তাজমেরি এসএ ইসলাম সকালের খবরকে বলেন, ভোজ্য তেলে অ্যাসিড ভ্যালু বেশি থাকলে তা ডায়াবেটিস, ক্যানসার, হূদরোগ, গ্যাস্টিক, আলসার ও অল্প বয়সে চামড়ায় ভাঁজ পড়াসহ বেশ কিছু রোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
তিনি আরও বলেন, ‘গবেষণায় যে তথ্য বরিয়েছে তা আমাদের জন্য খুবই উদ্বেগের বিষয়। কেননা ভোজ্য তেল প্রতিটি মানুষের নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় পণ্য এবং প্রতিদিন আমরা বিভিন্ন খাদ্যের সঙ্গে ভোজ্য তেল খাচ্ছি। আসলে ভোজ্য তেলের নামে আমরা বিষ খাচ্ছি।’
ভেজাল : এর আগে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ভোজ্য তেল নিয়ে একটি পরীক্ষা চালায়। তাদের পরীক্ষার প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশে ব্যবহূত ভোজ্য তেলে ব্যাপক ভেজাল রয়েছে।
সংস্থার পরীক্ষায় দেখা যায়, দেশে বিক্রি হওয়া ভোজ্য তেলের ৮৭ শতাংশই ভেজাল। ভোজ্য তেলে এসিটিক অ্যাসিডের মাত্রা সহনীয় মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি। পাশাপাশি তেলের গুণগত মানও বেশ নিচু। প্রতিষ্ঠানটি মান যাচাইয়ের জন্য সয়াবিন তেলের ৪০০ নমুনা সংগ্রহ করে। পাবলিক হেলথ ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষায় ৩৪৯টিতে বা ৮৭ দশমিক ২৫ শতাংশ নমুনায় ভেজাল শনাক্ত হয়।
পরীক্ষায় মাত্র ৫১টি বা ১২ দশমিক ৭৫ শতাংশ নমুনায় সব উপাদান সঠিক মাত্রায় পাওয়া যায়। বাকি নমুনায় এসিটিক অ্যাসিডের মাত্রা ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। সাধারণত ভোজ্য তেলে উপাদানটি এক শতাংশের নিচে থাকার কথা থাকলেও ৮৭ দশমিক ২৫ শতাংশ নমুনায় উপাদানটি পাওয়া যায় তার চেয়ে বেশি মাত্রায়।
পরীক্ষায় আরও দেখা যায়, এসব সয়াবিন তেলের মধ্যে পাম বা নিম্নমানের তেলের মিশ্রণ রয়েছে ব্যাপক। এ ছাড়া পরীক্ষায় অধিকাংশ কোম্পানির তেলে অ্যাসিডের মাত্রা বেশি রয়েছে। যেসব নমুনায় উপাদানগুলো সঠিক অনুপাতে পাওয়া যায়নি, সেগুলোকেই ভেজাল বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।
বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) তথ্য অনুযায়ী, সঠিক মানের সয়াবিন তেল নির্ণয় করতে এর রং, অ্যাসিড ও আয়োডিন ভ্যালু, রেজিস্টিভ ইনডেক্স ও মেল্টিং পয়েন্ট পরীক্ষা করা হয়। যেসব তেল সঠিক পরীক্ষার মধ্য দিয়ে পরিশোধন করা হয়, সেগুলোয় অ্যাসিড ভ্যালু কম থাকে। যেগুলোয় অ্যাসিড ভ্যালু বেশি থাকে, সেগুলো পরিশোধন ছাড়াই বা স্বল্প পরিশোধনে বাজারজাত করা হয়।
অন্যদিকে ভোজ্য তেলে ভেজাল রয়েছে কি না সেটি যাচাই করে দেখার দায়িত্ব বিএসটিআইর। এ বিষয়ে বিএসটিআইর অতিরিক্ত পরিচালক রিয়াজ উদ্দিন বলেন, আমরা বিভিন্ন সময় ভেজালবিরোধী অভিযান চালিয়েছি ভোজ্য তেলের বাজারে। সে সময় অনেক ভেজাল তেল জব্দ করা ও সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীকে জরিমানাও করা হয়েছে। কিন্তু জনবল সঙ্কটের কারণে আমরা সারাদেশে ঠিকমতো বাজার অভিযান চালাতে পারি না সব সময়। ব্যবসায়ীরা হয়তো এ সুযোগটি নিতে পারে।
শেয়ার !

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *