নারীর মেনোপজ এবং মানসিক সমস্যা

shajghor-Dorctor-dনারীদের ঋতুস্রাব স্থায়ীভাবে বন্ধ হওয়াকে মেনোপজ বলে। এই সময়ে অনেকে মানসিক সমস্যায় ভুগতে থাকেন। এটি থেকে রক্ষা পেতে চিকিৎসা নেওয়া প্রয়োজন।

প্রশ্ন : মেনোপজ কী?

উত্তর : প্রতিটি নারীরই সাধারণত ১২ বছর বয়স থেকে প্রতি মাসে যে রক্তপাত হয়, তাকে মাসিক বা ঋতুচক্র বলা হয়। এটি যখন স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যায় এবং নিয়মিত যখন ১২ মাস বন্ধ থাকে, তখন একে আমরা মেনোপজ বলি। সাধারণত এটি ৪০ বছর বয়স থেকে শুরু হয়। কারো কারো ক্ষেত্রে ৫০ বা ৫৫ বছর বয়সে হতে পারে।

প্রশ্ন : এই সময়ে তার কী ধরনের সমস্যা হতে পারে?

উত্তর : মেনোপজ খুব প্রাকৃতিক এবং স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। প্রত্যেকটি নারীর জীবনে এটি ঘটে থাকে। এটা কোনো রোগ নয়। এই বিষয়টিকে যখন মানুষ স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেন না, তখনই তাঁরা বিভিন্ন ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হন। এর কারণে তাঁদের শুধু প্রজননক্ষমতা নষ্ট হয়। বাচ্চা উৎপাদন করতে পারে না। কিন্তু তাঁদের যৌনক্ষমতার কোনো পরিবর্তন হয় না বা অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায় যৌনক্ষমতা বেড়েও যায়।

অনেকে মনে করেন আমার জীবন শেষ। আবার স্বামী হয়তো আর আমার দিকে ফিরেই তাকাবেন না বা আমি আমার সন্তানদের কাছ থেকে খুব দূরে সরে গেলাম। ওনারা হয়তো ভাবেন আমি মনে হয় সারা জীবনের জন্য অক্ষম হয়ে গেলাম। এই চিন্তার কারণে, তাঁরা আশাহীন ও অসহায় হয়ে পড়েন। সব সময় একটি শূন্যতা অনুভব করতে থাকেন। মূলত তাঁদের এটি জানতে হবে যে এটি একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। এটি প্রত্যেকের জীবনেই হয়। এই বিষয়টি যদি আমরা ভালোমতো ডিল করতে (বোঝাতে) পারি তাহলে হয়তো বা আমরা স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারব।

একটু সতর্ক থেকে, আমরা যদি শারীরিক পরিশ্রম করি, ভারসাম্যপূর্ণ খাদ্যাভ্যাস খেতে পারি, ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার বেশি পরিমাণ খেতে পারি বা সবজি যদি বেশি পরিমাণে খাই; বা মুরগির মাংস, কলিজা, শাকসবজি, ব্রকলি—এসব খাবার যদি আমরা খাই, ভিটামিন-এ ও ম্যাগনেসিয়াম-সমৃদ্ধ খাবার খাই- তাহলে নারীদের যেসব শারীরিক উপসর্গগুলো দেখা দেয় সেগুলো কমবে। সবচেয়ে প্রকট আকারে যেই সমস্যাটি দেখা দেয়, তাঁদের ক্যালসিয়ামের অভাবে হাড় ক্ষয় হতে থাকে। যাকে আমরা বলি অস্টিওপরোসিস।

আর কিছু শারীরিক লক্ষণ, যেমন হট ফ্লাসেস হয়। হঠাৎ করেই দেখা যায় যে কান এবং মাথা খুব গরম হয়ে গেল বা শরীর গরম হয়ে গেল বা শরীর অত্যধিক গরম লাগতে থাকল, শরীর অত্যধিক ঘামতে থাকল। এ রকম সমস্যা হয়।

প্রশ্ন : এটি কি মেনোপজের আগেই হয়, নাকি মেনোপজ শুরু হয়ে যাওয়ার পর হয়?

উত্তর : এটা দেখা যায় পেরিমেনোপজাল পর্যায়ে হয়। ধরুন চল্লিশের আগেই বা চল্লিশ বছর পর থেকে মাসিক পুরোপুরি বন্ধ হলো না, তবে অনিয়মিত হয়ে গেল। বা গতি একটু কমে গেল। তখন দেখা যায় যে এই হট ফ্লাস বা বিভিন্ন শারীরিক উপসর্গগুলো দেখা দিতে পারে। এগুলো হলো সতর্কীকরণ চিহ্ন। মেনোপজ হওয়ার দুই বছরের মধ্যে এটি কমে যায়।

প্রশ্ন : মেনোপজাল পর্যায় রোগী কখন আপনাদের কাছে মানসিক সমস্যা নিয়ে আসে?

উত্তর : দেখা যায় যে নারীরা যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে সন্তান লালন পালন করেছেন, সন্তান নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন একসময়, মেনোপজ হওয়ার সময়টিতে দেখা যায় তাঁদের সন্তানরা পড়াশোনা করে সফল হয়ে যায়, কারো কারো বিয়ে হয়ে যায়। তখন তাঁরা খুব একাকিত্বে ভোগেন। অথবা তাঁদের একটি অনিরাপত্তা বোধ চলে আসে। এটি স্বামীর সঙ্গে সম্পর্কের ওপর নির্ভর করে। যদি  স্বামী তাঁকে খুব সাহায্য করে থাকেন, তাহলে সমস্যাটি প্রকট আকার ধারণ করে না। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় সম্পর্কটা অতটা ভালো নয়, সেই ক্ষেত্রে তাঁরা অনিরাপত্তাবোধ করতে থাকেন। আর কিছু শারীরিক যেই উপসর্গ দেখা যায়, এর কারণে উদ্বেগ ও বিষণ্ণতা কাজ করে। অনেকে আবার কোমর ব্যথা বা পিঠ ব্যথা বা হাঁটুতে ব্যথা নিয়ে আসেন। তাঁদের ঘুমের সমস্যা থাকে, খাওয়াদাওয়ায় অরুচি থাকে। কাজ করতে ভালো লাগে না। সব কিছুতেই অনীহা চলে আসে।

প্রশ্ন : আপনারা তখন কী পরামর্শ দেন?

উত্তর : আমরা তখন তাঁদের সাইকো-এডুকেশন করি। প্রথমে তাঁদের বুঝিয়ে বলা যে এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া এবং কী কারণে এটা হয়ে থাকে। আর চিকিৎসা ব্যাপারে কীভাবে এটি ব্যবস্থাপনা করতে হবে সেটি বলা হয়। সাধারণত ইসট্রোজেন বা প্রোজেস্টেরন হরমোন কমে গেলে এই মেনোপজ হয়। এ ছাড়া বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ওভারির ওভাম উৎপাদন কমে যায়। তখন সেটি আর ঋতুস্রাবের রক্তের সঙ্গে বের হতে পারে না। সেই কারণেই তখন কিন্তু মেনোপজ হয়।

প্রশ্ন : এই বিষয়গুলোর সঙ্গে খাপ খাওয়ার জন্য কী ধরনের পরামর্শ তাঁদের দেন?

উত্তর : অনেক সময় আমরা কর্মব্যস্ততার কারণে পছন্দের বা ভালো লাগার কাজটুকু করতে পারি না। যেমন ছোটবেলায় আমরা কেউ গান শিখতাম বা কবিতা আবৃত্তি করতাম বা অনেক বেশি ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করতাম। পারিবারিক জীবনে এসে কর্মব্যস্ততার কারণে এই কাজগুলো হয়তো করতে পারিনি। সেই সময়গুলোতে তিনি তাঁর ওই চর্চাগুলো করতে পারেন। বা সৃষ্টিশীল কাজ বা সমাজসেবামূলক কাজগুলো করতে পারেন বা আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর কাজ করতে পারেন। সম্পর্কের উন্নতি ঘটানোর কাজ করতে পারেন। পাশাপাশি শরীর ও মনকে শিথিল রাখার জন্য যে ব্যায়াম আছে, সেগুলো করতে পারেন। ধ্যান করা বা যোগব্যায়াম করা বা ব্যায়াম করতে পারেন বা পারলারে গিয়ে শরীর ম্যাসাজও করতে পারেন। খাদ্যাভ্যাসের ভারসাম্য আনতে পারেন।

প্রশ্ন : তাঁর পরিবার বা সঙ্গের মানুষকে নিয়ে সে পরামর্শটি আপনারা দেন কিনা বা তার ওপর আসলে কী দায়িত্ব থাকে?

উত্তর : একে আমরা অনেক ক্ষেত্রে বলি কাপল থেরাপি বা ফ্যামিলি কাউন্সেলিং। এটা আমরা করে থাকি। কারণ অজ্ঞতার কারণেই বিষয়টি হয়। যিনি ভুগছেন, তিনিও অজ্ঞতার কারণেই করছেন এবং যাঁরা আশেপাশে আছেন, তাঁর ঘনিষ্ঠজন তাঁরাও কিন্তু অনেক সময় বিষয়টি বুঝতে পারেন না যে এই পর্যায়ে একজন নারীর মানসিক অবস্থা কেমন থাকে।

তাকে অবজ্ঞা করা যাবে না। এটি একটি খুব প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। এটা সবারই হয়। একে মেনে নিতে হবে। যখন সেই নারী বিষয়টিতে ভুগছেন, তাঁর পাশে এসে দাঁড়াতে হবে। তখন তাঁকে দূরে সরিয়ে দেওয়া যাবে না। তাঁকে কটূক্তি করা যাবে না। অবহেলা করা যাবে না। এই বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে হবে এবং তাকে সাহায্য করার জন্য যা যা দরকার, চিকিৎসা থেকে শুরু করে, এমনকি শিথিল করার জন্য প্রতিটি ব্যবস্থা পরিবারের লোকজনের নিতে হবে।

প্রশ্ন : ঝুঁকি রয়েছে কতখানি যদি সঠিক সময়ে সমস্যা ধরা না হয়?

উত্তর : এই প্রতিটি বিষয়ই আসলে অনেকগুলো বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। একজন মানুষের ব্যক্তিত্ব কী রকম? উনি প্রতিটি বিষয় কীভাবে নিতে পারেন? তাঁর শারীরিক কোনো রোগ আছে কি না এবং তাঁর কত বছর বয়সে এ রকম হয়েছে। বছর বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কিন্তু অন্যান্য শারীরিক সমস্যা হয়। যেমন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ। যাঁর অ্যাজমা থাকে সেগুলো আরো বেড়ে যায়।

পরিবারের সদস্যরা সহানুভূতিশীল কি না। তাঁর আর্থিক অবস্থা কী রকম- এই প্রতিটি বিষয়ের সঙ্গে এটি সম্পর্কিত যে তাঁর সমস্যাগুলো কতটুকু প্রকট আকার ধারণ করবে।

এটা কি শুরুতেই শেষ হয়ে যাবে, নাকি বাড়তে বাড়তে অনেক বিশাল পর্যায়ে যাবে। বিশাল মানসিক রোগের আকার ধারণ করবে, যাতে করে ওই পর্যায়ে না যায়, সে জন্য চিকিৎসা শুরু করে দিতে হবে-সবই এসবের ওপর নির্ভরশীল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *