রোজার সব ভালো

05
রোজার মূল লক্ষ্য তাকওয়া অর্জন করা। তবে ওজন কমানো বা বাড়ানোর জন্যও ভালো সুযোগ রোজা। অনেক শিশু বায়না ধরে রোজা রাখার। শিশুরা রোজা রাখলে তাদের জন্য আলাদা করে নজর দিতে হবে খাদ্য তালিকায়।

ওজন কমাতে

ওজনের ভারসাম্য বজায় রাখা খুব জরুরি। বেশি ওজন যাঁদের, তাঁদের ওজন কমানোর বিশেষ সুযোগ করে দেয় রোজা। তবে রোজায় অনেক মানুষ প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাবার খেয়ে ফেলে। এ ছাড়া তেলে ভাজা মসলাদার ও অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবারের ফলে শরীরে বাড়তি চর্বি জমে। এ সময় শারীরিক পরিশ্রমও তুলনামূলক কম হয়। ভাজাপোড়া, চিনি জাতীয় খাবার গ্রহণ, অন্যদিকে পরিশ্রম না করাও রোজায় ওজন বাড়ার অন্যতম কারণ।

রোজায় ব্যায়াম বা কায়িক পরিশ্রম করে ক্যালরি ঝরানোর চেয়ে স্বাভাবিক শারীরিক শ্রমগুলো যা আগেও করতেন, তা রোজার মধ্যেও বজায় রাখুন। সাধারণ দিনের মতোই রোজায় খাবার খান পরিমিত পরিমাণে। সচেতন হোন ইফতারে। পানি আর খেজুর দিয়ে ইফতার শুরু করতে পারেন। পানিতে ইসবগুল-লেবু মেশাতে পারেন। খেজুরে যথেষ্ট মিষ্টি থাকে, তাই শরবত বা জুসে অল্প পরিমাণে চিনি মেশান। শসা, ডাবের পানি ও ফল রাখা যেতে পারে। মুড়ির বদলে ভেজানো চিঁড়া রাখুন মেন্যুতে। সঙ্গে দই, কলা বা আম থাকতে পারে। ইফতারে খেজুর, স্যুপ, স্টিমড বা বয়েল্ড চিকেন অথবা ফিশ, ছোলা, রুটি বা ওটস ও টক দই খাওয়া যেতে পারে। পিয়াজু, বেগুনি, পাকোরা তেলে না ভেজে বেক বা এয়ার ফ্রাই করে নিন। মিষ্টি খেতে চাইলে পুডিং, ফ্রুট সালাদ, বেক করা পাই খাওয়া যাবে।

এ ছাড়া গাজর, আপেল, আঙুর খেতে পারেন। ওজন কমানোর জন্য মিষ্টিজাতীয় ফল বাদ দিয়ে টক ফল রাখুন। অথবা সব ফল দিয়ে আর টক দই দিয়ে ফ্রুট সালাদ বানিয়ে খেতে পারেন। এনার্জি পাবেন। ওজন বাড়ার আশঙ্কা থাকবে না।

ইফতার-পরবর্তী রাতের খাবারটাও হওয়া চাই হালকা। ইফতারে হালকা খাবার খেয়ে বরং রাতের খাবারে ভাত-মাছ-মাংস-সবজি খান। এ সময় আমড়া, পাতলা ঝোলজাতীয় খাবার পাতে রাখুন। রাতের খাবারটা হালকা ও স্বাস্থ্যসম্মত হবে। সেহরি ও রাতের খাবারে বেশি পরিমাণে মাছ বা ডিম রাখতে পারেন। প্রতিদিনকার মেন্যুতে এক বাটি সবজি অবশ্যই রাখুন। একই ধরনের খাবার রাখুন সেহরিতে। সাদা চাল বা আটার পরিবর্তে লাল চালের ভাত বা লাল রুটি খান। এতে ক্যালরি কম থাকলেও হজম হতে বেশ সময় লাগে। শাক বা বেশি আঁশযুক্ত সবজি রাতে না খেয়ে সেহরিতে খান। হজমের গণ্ডগোল হবে না। সারা দিনের এনার্জিতেও টান পড়বে না।

রোজায় ওজন কমানোর আরেকটি উপায় হতে পারে প্রচুর পানি পান করা। ইফতারের সময় দুই গ্লাস। এ ছাড়া ইফতার ও সেহরির মধ্যবর্তী সময় এক ঘণ্টা পর পর এক গ্লাস করে মোট ৪ গ্লাস পানি পান করুন। সেহরির সময় দুই থেকে তিন গ্লাস পানি পান করলে অন্যান্য খাবারের আগ্রহ কমে যাবে। মনে রাখবেন, ইফতারের পর বা রাতে ঘুমানোর আগে আধা ঘণ্টা হাঁটা আপনার লক্ষ্যে পৌঁছতে একধাপ এগিয়ে রাখবে।

ওজন কমানোর ব্রত নিতে প্রথম রোজার দিন ওজন লিখে রাখুন। সাত দিন পর আবার ওজন দিন। অগ্রগতি না পেলে হতাশ হবেন না। এভাবে মাসে চারবার ওজন নিন। মাসের শুরুতে লক্ষ্য স্থির করুন, কমপক্ষে পাঁচ কেজি ওজন কমবে। তারপর মাস শেষে চাঁদরাতে ওজন দেখুন, আপনার পাঁচ কেজি ওজন কমেছে কি না। এটি শুধু অতিরিক্ত ওজন আছে—এমন ব্যক্তির জন্য প্রযোজ্য। ডায়াবেটিক রোগী, উচ্চরক্তচাপ, নিম্নরক্তচাপ, কিডনিরোগী, হৃদরোগী এই তালিকা গ্রহণ করবেন না।

ওজন বাড়াতে

অতিরিক্ত কম ওজন নিয়ে কষ্টে আছেন—এমন মানুষের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। তাঁদের বেশির ভাগই রোজা রাখা নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় থাকেন। ওজন আরো কমে যাওয়ার ভয়ে ইফতার ও সেহরির মেন্যুতে ভারী খাবার খেয়ে ফেলেন, যা একেবারেই ঠিক নয়। ওজন কমাতে শারীরিক পরিশ্রম ও জীবনযাপনের সঙ্গে মিল রেখে ওজন, বয়স ও উচ্চতা অনুযায়ী ইফতার ও মেন্যু নির্বাচন করবেন। রোজা রাখার ফলে শরীরের সংরক্ষিত পুষ্টি উপাদানগুলো ভেঙে আমাদের শক্তির চাহিদা পূরণ করে, তাই ওজন কমে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। এ জন্য সেহরির খাবার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কোনোভাবেই সেহরির খাওয়া বাদ দেওয়া যাবে না। খাবার তালিকায় শস্য (ভাত, রুটি ইত্যাদি), মাছ-মাংস, ফলমূল, শাকসবজিসহ রাখতে হবে ডিম, দুধ ও দুগ্ধজাতীয় খাদ্য, বাদাম, পিনাট বাটার ইত্যাদি। ইফতারের আহার দুই ভাগে ভাগ করে নিতে হবে।

রোজা খুলতে হবে জুস বা মিল্কশেক ও খেজুর এবং দুধ/দই ও কলা দিয়ে তৈরি চিঁড়া দিয়ে। এর সঙ্গে ঘরে তৈরি অন্যান্য আইটেম যেমন—ছোলা, সালাদ, পায়েস ইত্যাদি খাবার খাওয়া যেতে পারে। রাতে আবার রুটি, সবজি ও ফল (কমলা, তরমুজ, আম, আঙুর, আনারস, নারিকেল, আপেল, নাশপাতি ইত্যাদি) খেলে ভালো।

শিশুর রোজা

পরিবারের বড়দের দেখে ছোট শিশুটিও রোজার বায়না ধরে। শিশুর সারা দিন না খেয়ে থাকাটা বেশির ভাগ মা-বাবা মেনে নিতে পারেন না। খুব কম বয়সী শিশুদের রোজা না রাখাই ভালো। রাখলে প্রথম প্রথম অর্ধদিবস পর্যন্ত, এরপর আস্তে আস্তে সম্পূর্ণ রোজা রাখার অভ্যাস করানো যেতে পারে। শিশুরা এক দিন পর এক দিন সম্পূর্ণ রোজা রাখলে ভালো।

সেহরির খাবার সারা দিন শক্তি জোগালেও ভোররাতে শিশুরা বেশি খেতে পারে না। তাই অল্প খাবারে পুষ্টি নিশ্চিত হয়—এমন মেন্যু নির্বাচন করুন। এই সময় দেরিতে হজম হবে এমন ফাইবার-রিচ খাবার যেমন—শস্য (ভাত, আটার রুটি ইত্যাদি); ডাল, মাছ-মাংস, ডিম, দুধ, বাদাম, ফল (কলা, আম, আঙুর, তরমুজ, নাশপাতি, খেজুর ইত্যাদি) এবং শাকসবজি রাখুন মেন্যুতে। ভাত, মাছ, মুরগি বা গরুর মাংস বা খিচুড়িসহ পছন্দসই খাবার দিন। জোর করবেন না। জোর করে খেলে বদহজম, অরুচি, গ্যাস সৃষ্টি হওয়াসহ নানাবিধ সমস্যা হতে পারে। দুধ, ফিরনি বা অন্যান্য মিষ্টিজাতীয় খাবার দিতে পারেন। প্রোটিনের চাহিদা পূরণ হবে। তবে অন্য খাবার না খেয়ে অতিরিক্ত চিনিযুক্ত খাবার খেলে অতি দ্রুত ক্ষুধা পাবে।

ইফতার থেকে সেহরি অবধি অন্তত ৬ গ্লাস পানি খেতে দিন। চাইলে আধা গ্লাস শরবত ও আধা গ্লাস গ্লুকোজ দিতে পারেন। ইফতারের পর থেকে শেষ রাত পর্যন্ত পানির পাশাপাশি শরবত, তাজা ফলের রস, হরলিকসসহ বেশি করে তরল খাবার দিন। শিশুর ইফতারে উত্তম খাবার হলো খেজুর, দুধ-চিঁড়া ও ফ্রুট জুস।

তবে বেগুনি বা ছোলা-মুড়ি খেতে নিষেধ নেই শিশুর। সে ক্ষেত্রে সঙ্গে পর্যাপ্ত ফল বা সালাদ, জুস বা তরল খাবার দিন। নানা রকম ফল মিশিয়ে কাস্টার্ড তৈরি করেও দিতে পারেন। রঙিন ফলের সালাদ ও ফালুদা, হালুয়া বা পুডিংও চলতে পারে। স্যুপে ডিম ও মাংসের ব্যবহার শিশুকে জোগাবে প্রয়োজনীয় পুষ্টি। যদি মুড়ি-চিঁড়া না খায়, তাহলে তাকে তৈরি করে দিতে পারেন ফ্রেঞ্চ ফ্রাই। ঘরেই বার্গার তৈরি করে দিতে পারেন শিশুকে। বেশি করে মাংস দিয়ে বার্গার তৈরি করলে সে খেয়েও মজা পাবে, আবার তার পুষ্টির চাহিদাও পূরণ হবে। এ ছাড়া মুরগির মাংস ভেজে দিতে পারেন। দিতে পারেন ডিম অথবা মাংসের চপ। দেশি ফল আইসক্রিমের সঙ্গে মিশিয়ে দিতে পারেন। এটি শিশু মজা করেই খাবে। বাইরের সব ধরনের খাবার পরিহার করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *