ইসলামের দৃষ্টিতে ঘরের বাইরে নারীর কাজ

নারী-পুরুষ উভয়ে মানুষ—তবু সৃষ্টিগত বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে উভয়ের দায়িত্ব বণ্টন করা হয়। স্বভাবগতভাবে সাধারণত নারীরা ঘরের গুরুদায়িত্ব পালন করে। পরিবার দেখাশোনা, সন্তানদের প্রতিপালন ও সুখময় দাম্পত্য জীবনে সহায়ক যাবতীয় কাজ সম্পাদন করে।

ইসলামে নারীকে ব্যয়ভার বহন করা থেকে পুরোপুরি মুক্তি দেওয়া হয়েছে।

নারীর ব্যয়ভার পর্যায়ক্রমে পিতা, স্বামী ও সন্তানের ওপর ন্যস্ত। তা সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ইসলাম নারীর জন্য স্বহস্তে উপার্জনের পথ খোলা রেখেছে। ইসলামী শরিয়তের বিধান মেনে মুসলিম নারীরাও উপার্জন করতে পারে। চাকরি করতে পারে, ব্যবসা করতে পারে। কৃষিকাজে শরিক হতে পারে। বিভিন্ন পেশা গ্রহণ করতে পারে। মহান আল্লাহ ব্যবসার বৈধতা দিয়েছেন। এই বৈধতা নারী ও পুরুষ সবার জন্য। পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘হে মুমিনরা, তোমরা একে অন্যের সম্পত্তি অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না; কিন্তু তোমাদের পরস্পর সন্তুষ্টচিত্তে ব্যবসা করা বৈধ…। ’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ২৯)

ব্যবসা ও লেনদেনের এই বৈধতা নারী ও পুরুষ সবার জন্য। লেনদেনের ক্ষেত্রে পুরুষ যেভাবে সাক্ষী হতে পারে, নারীরাও পারে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘…সাক্ষীদের মধ্যে যাদের ওপর তোমরা রাজি, তাদের মধ্যে দুজন পুরুষ সাক্ষী রাখবে, যদি দুজন পুরুষ না থাকে, তাহলে একজন পুরুষ ও দুজন নারী। নারীদের মধ্যে একজন ভুল করলে অন্যজন স্মরণ করিয়ে দেবে। সাক্ষীদের যখন ডাকা হবে, তারা যেন অস্বীকার না করে। এটা ছোট হোক, বড় হোক—মেয়াদসহ লিখতে তোমরা কোনো ধরনের বিরক্ত হইয়ো না…। ’ (সুরা : বাকারা, আয়াতাংশ : ২৮২)

ইসলাম বিনা প্রয়োজনে নারীকে ঘর থেকে বের হতে নিষেধ করে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমরা নিজ গৃহে অবস্থান করবে। আর জাহেলি যুগের মতো নিজেদের প্রদর্শন করে বেড়াবে না…। ’ (সুরা : আহজাব, আয়াত : ৩৩)

তবে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে নারীরা ঘরের বাইরে যেতে পারবে। মা-বাবার সঙ্গে সাক্ষাৎ, স্বজনের মৃত্যু, বিবাহ-অনুষ্ঠান, চিকিৎসা ও ব্যক্তিগত প্রয়োজনে নারীরা ঘর থেকে বের হতে পারবে। পবিত্র কোরআনে এ বিষয়ে শোয়াইব (আ.)-এর দুই কন্যার ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘যখন সে [মুসা (আ.)] মাদিয়ানের কূপের কাছে পৌঁছল, দেখল একদল লোক প্রাণীগুলোকে পানি পান করাচ্ছে। আর তাদের পেছনে দুজন নারী তাদের পশুগুলোকে আগলে রেখেছে। সে [মুসা (আ.)] বলল, তোমাদের কী ব্যাপার? তারা বলল, আমরা আমাদের প্রাণীগুলোকে পানি পান করাতে পারি না, যতক্ষণ রাখালরা তাদের পশুগুলোকে নিয়ে না সরে যায়। আমাদের পিতা অতি বৃদ্ধ। ’ (সুরা : কাসাস, আয়াত : ২৩)

এ আয়াত থেকে জানা যায়, প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে নারীরা ঘরের বাইরে যেতে পারবে এবং কাজ করতে পারবে।

ইসলামের সোনালি যুগে ব্যবসা, কৃষি, হস্তশিল্প, সমাজসেবাসহ বিভিন্ন পেশায় নারীদের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া যায়।

ব্যবসা, চাকরি ও পেশা গ্রহণের ক্ষেত্রে ইসলাম চায় পেশাবৃত্তি যেন নারীর ব্যক্তিত্ব, সতিত্ব ও সম্ভ্রমের জন্য হুমকি হয়ে না দাঁড়ায়। তাই যৌক্তিক কারণে কর্মক্ষেত্রে নারীর বিচরণের ক্ষেত্রে ইসলাম কিছু শর্ত আরোপ করেছে। যেমন—

১.         পাপপূর্ণ কোনো পেশা গ্রহণ করা যাবে না। যেমন—নাচ, গান, পতিতাবৃত্তি, পানশালায় অতিথি আপ্যায়ন ইত্যাদি।

২.         এমন কোনো পেশা গ্রহণ করা যাবে না, যে পেশায় পরপুরুষের সঙ্গে নির্জনে ও একান্তে সময় পার করতে হয়। আর এর জন্য সর্বোত্তম পন্থা হলো নারীর পৃথক কর্মস্থল।

৩.         জাহেলি যুগের মতো অশালীন পোশাক ও সাজসজ্জায় বের হওয়া যাবে না, যা নারীর নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। (আল-মাওসুআতুল ফিকহিয়্যাহ আল-কুয়েতিয়্যাহ : ৭/৮৩-৮৪)

৪.         শক্তি-সামর্থ্যের বাইরে কষ্টকর কাজের বোঝা নারীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। তাই নারীর স্বভাব, স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তা ও শক্তি-সামর্থ্যের প্রতি লক্ষ রেখে পেশা গ্রহণ করতে হবে। যেমন—শিক্ষাদান, কেয়ারিং, নার্সিং ইত্যাদি পেশা নারীর অনুকূল।

৫.         ঘরের বাইরে কাজ করতে গিয়ে ঘরের যে গুরুদায়িত্ব নারীর ওপর অর্পিত, তা লঙ্ঘিত হতে দেওয়া যাবে না। অন্যথায় শুধু পরিবারের আয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে গিয়ে পরিবার ও সন্তানের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করে দেওয়া শুভবৃদ্ধির কাজ নয়।

৬.         নারীর নিরাপত্তা বিধানের জন্য এটাও জরুরি যে সে মা-বাবা/স্বামীর অনুমতিক্রমে তাদের জানিয়ে ঘর থেকে বের হবে।

৭.         কর্মস্থলে যথাসাধ্য শালীন পোশাক পরিধানসহ ইসলামের শরিয়তের বিধি-নিষেধ অনুসরণ করবে।

এটা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই যে কর্মক্ষেত্রে নারীদের বিচরণের মধ্য দিয়ে পরিবার, সমাজ ও দেশ অর্থনৈতিকভাবে আরো শক্তিশালী হয়। পরিবারে নারীর প্রভাব বাড়ে, দিনের অবসর সময়টুকু কাজে লাগে এবং সমাজে নারীর সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু পাশাপাশি এটাও ভুলে গেলে চলবে না যে পরিবার নারীর প্রতিপক্ষ নয়। নারী পরিবারের বাইরের কেউ নয় কিংবা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন কেউ নয়। সুতরাং অর্থ উপার্জনের ক্ষেত্রে এসব বিষয়ও বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ—

১.         সন্তান যেন যথাযথ আদর-সোহাগ ও প্রতিপালন থেকে বঞ্চিত না হয়।

২.         নারীর নিজের স্বাস্থ্যের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। ঘরে-বাইরে প্রচুর পরিশ্রম যেন নারীকে অসুস্থ করে না তোলে।

৩.         পরিবারের উপার্জন বাড়াতে গিয়ে নারী যেন পরিবারছাড়া হয়ে না যায়; নারী যেন নারীত্ব ও মাতৃত্বের কথা ভুলে না যায়, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।