কাবিননামার যে ধারা সম্পর্কে সবার জানা জরুরি!

কাবিননামার ১৮নং কলামের বিষয়বস্তু হলো- স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে তালাকের ক্ষমতা অর্পণ। বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর।

এখানে তিনটি বিষয় লক্ষ্য রাখতে হবে।  এক. স্বামী স্ত্রীকে শরীয়ত সমর্থিত নিয়মে তালাকের ক্ষমতা অর্পণ করা; দুই.  স্ত্রী তালাকের ক্ষমতা প্রাপ্ত হয়ে শরীয়ত সমর্থিত নিয়মে তালাক গ্রহণ করা; তিন. কাজী সাহেব বর ও কনেকে অবহিত করে সুস্পষ্ট ও সুচিন্তিত শর্তগুলো উল্লেখ করে ১৮নং কলামটি পূরণ করা।

আমাদের অনুসন্ধান মতে সব ক্ষেত্রেই  ভুল হয়ে থাকে।

তালাকের ক্ষমতা অর্পণের ক্ষেত্রে যে ভুলগুলো হয়ে থাকে:

১- কলামটি খালি রেখে দেওয়া
 
অনেক সময় কাজী সাহেব ১৮নং কলামটি পূরণ করেন না। বর ও কনেও বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন না। পরবর্তীতে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে বনিবনা না হলে, বিবাহ বিচ্ছেদ অপরিহার্য হলেও স্ত্রী নিজেকে স্বামী থেকে বিচ্ছেদ ঘটাতে পারে না। বরং যুগ যুগ ধরে জুলুম-নির্যাতন মুখ বুজে সহ্য করতে হয়।

২- কলামটি পূরণ করার সময় শুধু হ্যাঁ শব্দ লেখা
   
হ্যাঁ লেখা দ্বারা নিঃশর্ত তালাকের ক্ষমতা অর্পণ করা হয়। সাধারণত মেয়েরা আবেগী হয়ে থাকে। নিজের রাগকে কমই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তাই তাদেরকে নিঃশর্ত তালাকে ক্ষমতা দিলে তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে সাজানো সংসারকে যেকোনো সময় তছনছ করে দিতে পারে।

৩- গৎবাঁধা শর্তসাপেক্ষে ক্ষমতা দেওয়া

অনেক কাজী ১৮নং কলামটি পূরণের জন্য নিজে থেকে একটা গদবাধা ভাষ্য তৈরি করে নেয়। কেউ কেউ নির্দিষ্ট বাক্য সংবলিত সিলমোহরও বানিয়ে নেয়। এরপর ঢালাওভাবে সকল কাবিননামায় ওই গদবাধা ভাষ্যই ব্যবহার করে। 

কোনো বর যদি এর বিপরীতে তার নিজের দেয়া কোনো কথা লিখতে বলে তখন কাজীরা তা লিখতে অস্বীকৃতি জানায় এবং বলে, এভাবে লেখা নিয়ম না। আমি এভাবে লিখতে পারবো না। অন্যান্য কাবিনে যা লিখি আমাকে তা-ই লিখতে হবে।

ওই গৎবাঁধা শর্তসমূহ থেকে একটি হল, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বনিবনা না হলে স্ত্রী তালাক গ্রহণ করতে পারবে। তো এখানে বনিবনা না হলে যে কথাটি একটু চিন্তা করলে বুঝা যায় একটি হালকা শর্ত। অনেকটা বিনা শর্তে তালাক গ্রহণের ক্ষমতা অর্পণের নামান্তর। 

কেননা প্রতিটি বৈবাহিক সম্পর্কেই কিছু না কিছু মনোমালিন্য হয়েই থাকে। মাঝে মাঝে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তরকারিতে লবন কমবেশি বা ঝাল-ঝোল কমবেশি হওয়া নিয়েও মতের অমিল হয়ে থাকে। এসব অমিল বা মনোমালিন্য অস্থায়ী। কিছুক্ষণ পর আবার সব ঠিক হয়ে যায়। 

তো বনিবনা না হলেই যদি স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে তালাক গ্রহণের ক্ষমতা দেয়া থাকে সেক্ষেত্রে স্ত্রী বলতে পারে যে, এতটুকুতেই স্বামীর সঙ্গে আমার বনিবনা হয়নি তাই তালাক নিয়েছি। অথচ হালকা মনোমালিন্যে স্ত্রীর তালাক গ্রহণের ক্ষমতা সৃষ্টি হওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনভিপ্রেত।

৪- তিন তালাকের ক্ষমতা অর্পণ করা:

সত্যিকার অর্থে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে বনিবনা না হলে ,তারা সংসার করতে না চাইলে স্ত্রী নিজের উপর এক তালাকে বায়েন গ্রহণ করে তার উদ্দেশ্য সাধন করতে পারে। অর্থাৎ বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটিয়ে সে অন্যত্র বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে।  

তিন তালাকের ক্ষমতা অর্পণের কোন প্রয়োজন নেই। বরং তিন তালাকের ক্ষমতা হস্তান্তরের কারণে অনেক সময়  তাদের জন্য সংসার করা চিরতরে হারাম হয়ে যায়। কারণ অনেক ক্ষেত্রে আবেগী হয়ে  স্ত্রী তার স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে দেয়। পরক্ষণে একত্রে ঘর সংসার করতে চায়। এক্ষেত্রে এক তালাকে বায়েনের ক্ষমতা প্রাপ্ত হয়ে এক তালাক দিলে নতুন ভাবে তারা বিবাহ করে নিলেই পুনরায় সংসার করতে পারে। আর তিন তালাকের ক্ষমতা প্রাপ্ত হয়ে তিন তালাক গ্রহণ করলে তাদের পক্ষে আর সংসার করা সম্ভব হয় না।

৫- ইজাব কবুলের আগেই কাবিননামায় বর-কনে থেকে স্বাক্ষর নিয়ে নেওয়া

অনেক সময় দেখা যায়, সরকারি কাজি বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে তাগাদা দিতে থাকে, ‘কাবিনের কাজ শেষ করে ফেলুন। আমার জরুরি কাজ আছে। আমি চলে যাই। পরে আপনারা মসজিদের ইমাম সাহেবকে দিয়ে বিয়ে পড়িয়ে নেবেন। ’

উক্ত পন্থায় স্ত্রী তালাকের ক্ষমতা প্রাপ্ত হয় না। কারণ তখন তো ইজাব কবুল না হওয়ায় স্বামী ই তালাকের মালিক হয়নি। তো সেখানে তার স্ত্রীকে তালাকের ক্ষমতা অর্পণ করবে কিভাবে?

৬- একটি সাদা কাগজে বর কনে এবং সাক্ষীদের স্বাক্ষর নেওয়া

অনেক সময় কাজী সাহেব একটি সাদা কাগজে বর-কনে এবং সাক্ষীদের স্বাক্ষর নিয়ে থাকে। পরবর্তীতে  অফিসে গিয়ে নিজের মন মত করে কাবিননামা পূরণ করে।

স্ত্রী তালাক গ্রহণের ক্ষেত্রে যে ভুলগুলো করে:

(ক) ভালো-মন্দ বিবেচনা না করে হুট করে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেওয়া

দাম্পত্য জীবনে ঝগড়া-বিবাদ ,মনোমালিন্য হতেই পারে কিন্তু অনেক সময় দেখা যায় কোন কোন স্ত্রী স্বামীর সঙ্গে একটু মনোমালিন্য হলেই সে আবেগপ্রবণ হয়ে যায়।  ভালো-মন্দ বিবেচনা  করে না। অভিভাবকের সঙ্গে পরামর্শ করে না। 

তালাক গ্রহণের শর্তগুলো আদৌ পাওয়া গেল কিনা সেগুলো বিবেচনা না করে হুট করে স্বামীর কাছে ডিভোর্স নামা পাঠিয়ে দেয়। পরবর্তীতে সে অনুতপ্ত হয় কিন্তু তখন আর ক্ষমতা তার হাতে থাকে না। আফসোস এবং দুঃখ প্রকাশ ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না।

(খ) স্বামীকে তালাক দিলাম বলা বা লেখা

তালাকে নোটিশে স্ত্রী তালাক শব্দকে নিজের দিকে সম্বন্ধ না করে স্বামীর দিকে সম্বন্ধ করে। যেমন বলে, আমি স্বামীকে তালাক দিলাম। অথচ শরীয়তের দৃষ্টিতে স্ত্রী তালাকের ক্ষমতা প্রাপ্ত হলে নিজেকে তালাক দিতে পারে, স্বামীকে নয়। কারণ তালাক পতিত হয় স্ত্রীর ওপর, স্বামীর ওপর নয়। 

তাবেয়ী মানসূর (রহ.) বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি তার স্ত্রীকে বলেছে, তোমার তালাক গ্রহণের ক্ষমতা তোমার হাতে। একথা শুনে স্ত্রী বলল, আপনি তিন তালাক। এ সম্পর্কে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, আল্লাহ তাআলা তাকে বৃষ্টি না দিন (অর্থাৎ তার উদ্দেশ্য সফল না হোক)। যদি সে (ওভাবে না বলে) বলতো, ‘আমি তিন তালাক’ তাহলে যা বলেছে তাই হতো।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা ৯/৫৮২)

১৮নং কলাম পূরণ করার ক্ষেত্রে স্বামীর করণীয়:

প্রথমত কাবিননামা কী? তার বিষয়বস্তু কী? তালাকের ক্ষমতা কিভাবে দিতে হয়? স্ত্রী কিভাবে তালাকে ক্ষমতা গ্রহণ করতে হয়? ইত্যাদি বিষয়গুলো সম্পর্কে কাজী, বর, কনে এবং অভিভাবক সকলেরই পর্যাপ্ত জ্ঞান অর্জন করা ।

বিশেষ করে কাজী সাহেব বর এবং কনে থেকে স্বাক্ষর নেওয়ার সময়  ১ নং কলাম সম্পর্কে তাদেরকে অবশ্যই অবহিত করা

(খ) সর্বোচ্চ এক তালাকে বায়েন গ্রহণের ক্ষমতা অর্পণ করা। কারন স্ত্রী এক তালাকে বায়েনের ক্ষমতা প্রাপ্ত হলে যদি তাদের মধ্যে বনিবনা না হয়, একসাথে সংসার করতে না চায় তাহলে নিজেকে তালাক দিয়ে অন্যত্র বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবেন।

(গ) উক্ত ক্ষমতার বাস্তবায়ন স্ত্রীর অন্তত যেকোন দু’জন অভিভাবকের অনুমতি সাপেক্ষে হওয়ার শর্ত আরোপ করা।

(ঘ) সুচিন্তিত ও সুস্পষ্ট কিছু শর্ত যুক্ত করে তালাকের ক্ষমতা দেওয়া। প্রচলিত হালকা ও গৎবাঁধা শর্ত না দেওয়া।

এক্ষেত্রে নিম্নোক্ত নিয়মে শর্তগুলো লেখা যেতে পারে। ‘বিবাহের পরে আমি যদি একেবারে নিরুদ্দেশ হয়ে যাই কিংবা অতিরিক্ত নির্যাতন করি, অথবা  একেবারেই ভাত-কাপড় না দেই তখন মোসাম্মাৎ ফাতেমা প্রতি-ঘটনার তিন দিনের মধ্যে, তার নির্ভরযোগ্য দুজন অভিভাবকের অনুমতিসাপেক্ষে নিজের ওপর এক তালাকে বায়েন নিতে পারবে’। 

লেখক: মুফতি ও মুহাদ্দিস, শেখ জনুরুদ্দীন র. দারুল কুরআন মাদ্রাসা, চৌধুরীপাড়া, ঢাকা