প্রসব পরবর্তী বিষণ্ণতা: কারণ, লক্ষণ ও করণীয়

মাতৃত্ব একজন নারীর জীবনের অনুপম অনুভূতি। আর একটি সুস্থ শিশুর জন্ম পরিবারে নিয়ে আসে আনন্দের বহুমাত্রিক উপলক্ষ্য। আনন্দের পাশাপাশি মাতৃত্বকালীন সময়টা একজন নারীর জীবনে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। শারীরিক বিভিন্ন প্রতিক্রিয়ার পাশাপাশি এ সময়ে নারীদের মোকাবিলা করতে হয় নানাবিধ মানসিক সমস্যারও। তবে এসব সমস্যা সন্তান প্রসবের সঙ্গে সঙ্গেই দূর হয়ে যায় না। কিছু মানসিক সমস্যা আছে যেগুলো নারীর প্রসব পরবর্তী সময়ে প্রকটভাবে দেখা দেয়। কিন্তু একটুখানি সচেতনতার অভাবে সেগুলো রয়ে যায় অবহেলিত। ফলে অনেকক্ষেত্রে শুশ্রুষার পরিবর্তে একজন নারীকে এ সময় সহ্য করতে হয় গঞ্জনাও।

সদ্য প্রসূতি মায়েদের অনেকেই প্রসব-পরবর্তী বিষণ্ণতায় (পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন) আক্রান্ত হন যা মা ও শিশু দু’জনের জন্যই ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে।

বেবি ব্লু

অনেক নারীর ক্ষেত্রেই সন্তান জন্ম দেওয়ার পরপর তাদের আচরণে কিছুটা পরিবর্তন দেখা যায়। এ সময় তাদের মধ্যে একাকীত্বে ভোগা, অতিরিক্ত আবেগপ্রবণতা, অতিরিক্ত রাগ দুঃখ বা হতাশায় ভোগার মতো কিছু উপস র্গদেখা দিতে পারে। এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। ৮০% নারীর ক্ষেত্রে শিশুর জন্মের সাত দিনের মধ্যেই এ ধরনের উপসর্গ দেখা দেয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় এটিকে বলা হয় “বেবি ব্লু”। সাধারণত, বেবি ব্লুর উপসর্গ দু সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। তার চেয়ে বেশি সময় স্থায়ী হলে সেটি হতে পারে প্রসব-পরবর্তী বিষণ্ণতা বা পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন। এক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্ম অনিবার্য। সেই সঙ্গে প্রয়োজন পরিবারের সদস্যদের ঐকান্তিক সহযোগিতা।

চিকিৎসকদের মতে, সন্তান জন্মদানের পর দেহে হরমোনের পরিবর্তনের কারণে এই জাতীয় ডিপ্রেশন হতে পারে। এছাড়া, গর্ভকালীন দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তি বা অবসাদ, বুকের দুধ খাওয়ানোর চ্যালেঞ্জ এবং প্রসবোত্তর অন্যান্য জটিলতার কারণেও এ সময় প্রসব পরবর্তী বিষণ্ণতা দেখা দিতে পারে।

হরমোনের পরিবর্তনের বাইরেও যেসব কারণে পরবর্তী বিষণ্ণতা দেখা দিতে পরে

• অতীত কোনো মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা

• বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা

• পারিপার্শ্বিক সহযোগিতার অভাব

• শৈশবকালীন কোনো কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা

• শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনের পূর্ব অভিজ্ঞতা

• সাম্প্রতিক মানসিক চাপ যেমন; বিবাহবিচ্ছেদ, মৃত্যু বা প্রিয়জনের গুরুতর অসুস্থতা

• অনাকাঙ্ক্ষিত বা অপ্রত্যাশিত গর্ভধারণ

• সময়ের আগে শিশুর জন্ম বা স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে জন্ম হওয়া

• একাকিত্ববোধ বা মানসিক সহযোগিতার অভাব

• ঘুমের সমস্যা এবং ক্লান্তি

• স্ট্রেসপূর্ণ জীবনযাত্রা, ইত্যাদি।

প্রসব পরবর্তী বিষণ্ণতা ব্লু থেকে একদমই আলাদা। এটি সাধারণত শিশুর জন্মের দুই থেকে আট সপ্তাহ পর্যন্ত দেখা দিতে পারে। কারো কারো ক্ষেত্রে এটি একবছর পর্যন্ত দেখা দিতে পারে। সঠিক শুশ্রুষা ও সহযোগিতা না পেলে পরবর্তী বিষণ্ণতার ক্ষত মা ও শিশুকে বয়ে বেড়াতে হয় আজীবন।

প্রসব-পরবর্তী বিষণ্ণতার কিছু লক্ষণ

• অস্থির লাগা বা মেজাজ খারাপ হয়ে থাকা

• কোনো কারণ ছাড়াই মন খারাপ বা কান্না আসা

• অতিরিক্ত ঘুম হওয়া অথবা প্রচণ্ড ক্লান্ত লাগলেও ঘুম না আসা

• খুব কম খাওয়া কিংবা অতিরিক্ত খাওয়া

• নানান ব্যথা বা অস্বস্তি অনুভব হওয়া

• সবকিছু অতিরিক্ত মনে হওয়া এবং হতাশ লাগা

• নিজেকে অসহায় লাগা

• মনোনিবেশ করতে বা সহজ সিদ্ধান্ত নিতে না পারা

• যে জিনিসগুলো এক সময় উপভোগ করতেন তাতে কোনো আগ্রহ না থাকা

• কাজে শক্তি বা অনুপ্রেরণা না পাওয়া

• শিশুকে বা নিজেকে আঘাত করার কথা চিন্তা করা

• সন্তানের প্রতি আগ্রহ কাজ না করা, তার থেকে দূরে থাকা। অর্থাৎ এমন মনে হওয়া যে সন্তান নিজের নয়, অন্য কারোর।

• স্মৃতির সমস্যা

• অপরাধবোধে ভোগা বা নিজেকে খারাপ মা মনে হওয়া

• পরিবার ও বন্ধুদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া বা পালাতে চাওয়া, ইত্যাদি।

প্রসবোত্তর বিষণ্ণতা একজন সদ্য প্রসূতি মা কিংবা তার নবজাতক শিশুর যত্ন নেওয়া কঠিন করে তুলতে পারে। তাই এর প্রতিকার এবং চিকিৎসা খুবই জরুরি।প্রসবোত্তর বিষণ্ণতা প্রতিরোধের উপায়চিকিৎসকের পরামর্শ

প্রসব পরবর্তী বিষণ্ণতার ক্ষেত্রে সবচেয়ে জরুরি চিকিৎিসকের পরামর্শ। কোনো নারীর মধ্যে বেবি ব্লু পরবর্তী মানসিক পরিবর্তনজনিত উপসর্গ থেকে গেলেই তাকে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।কথা বলা

প্রসব পরবর্তী সময়ে একজন নারীর জন্য এটা ভাবা জরুরি যে তিনি একা নন। তাই এ সময় অনুভূতিগুলোকে নিজের মধ্যে না রেখে বিশ্বস্ত কারো সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিলে সেটি খুব কার্যকরী।একা না থাকা

এ সময় একা না থেকে বরং পছন্দের মানুষগুলোর সঙ্গে বেশি বেশি সময় কাটান জরুরি। এটি একাকিত্ব দুর করে অন্যদের সংস্পর্শে যেতে সাহায্য করতে পারে।

এ সময় বিভিন্ন ধরনের গ্রুপে যুক্ত হতে পারেন। কোনো গ্রুপে থাকলে অন্যান্য বিষয়গুলোতে ফোকাস করা যায় ফলে নিজের মানসিক চাপ এমনিতেই কিছুটা হালকা হয়ে যায়। নিজের বন্ধু- বান্ধবী কিংবা আত্মীয়স্বজনের সঙ্গেও সময় কাটানো যেতে পারে।জোর করে কাজ না করা

আপনি যদি কাজ বা চাকরির জন্য প্রস্তুত না হন, তবে এ সময় নিজের ওপর জোর করবেন না। মনে রাখবেন এই সময়টা আপনার এবং আপনার শিশুর জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তাই প্রয়োজনে আরও কিছুদিনের জন্য কাজ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করুন।বিশ্রাম করুন এবং শান্ত থাকুন

মন ও শরীর উভয়কে ভালো রাখার জন্য রাতের ঘুম খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদি আপনার শিশু অনেকক্ষণ জেগে থাকে তাহলে অন্য কাউকে দায়িত্ব দিন, যাতে আপনি পর্যাপ্ত ঘুমাতে পারেন। আপনার শিশুর যত্নের জন্যই আপনার যথেষ্ট বিশ্রাম প্রয়োজন। এছা্ড়া, স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া, পরিমিত ব্যায়াম স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন প্রসব পরবর্তী বিষণ্ণতা মোকাবিলায় সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে।