মোবাইল-ইন্টারনেটে মজে থাকা প্রজন্ম

ছেলেটির নাম সুনীল। এইচএসসি পাস করার পর উচ্চ শিক্ষার জন্য বাবা-মা খুলনা থেকে ঢাকায় পাঠান তাদের আদরের সুনীলকে। দুই হাজার টাকা মাসে আরও তিনটি ছেলের সঙ্গে আজিমপুর এলাকার একটি মেসে ওঠে সুনীল। ঢাকায় আসার ১ মাসের মধ্যেই অবাধ স্বাধীনতা পেয়ে আশ্চর্যরকম ভাবে পরিবর্তন আসতে শুরু হয় সুনীলের মাঝে।

যে ছেলেটি খুলনায় মা-বাবার সঙ্গে থাকার সময় রাত ১২টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ত, সে এখন ঘুমাতে যায় ভোরের দিকে। স্কুল, কলেজে স্যারদের কাছ থেকে পাওয়া সুনীলের ‘বেস্ট বয়’ উপাধি হারিয়ে গিয়েছে এ মেসে জীবন শুরুর কয়েক মাসের মধ্যেই।

‘দিনে ঘুমাই রাতে জাগি’ টাইপের একটি ফেসবুক গ্রুপেই রাত কাটে সুনীলের। সুনীল প্রায়ই ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়, ‘উরাধুরা পড়ালেখা করুম’ ‘পড়তে পড়তে বেহুশ হয়ে যামু’ ইত্যাদি। পড়ার স্ট্যাটাসের কমেন্টে পড়ালেখা নিয়ে চলে খারাপ ভাষায় ফাজলামো। সারারাত ফেসবুকেই কাটিয়ে বেশিরভাগ দিনই সকালে ঘুম থেকে ওঠে কোচিং ক্লাসে যেতে পারেনি সুনীল।

ভর্তি পরীক্ষার জন্য ভালো করে প্রস্তুতি নিতে না পারায় ঢাবি, জাবিসহ কোথাও চান্স পায়নি। উচ্চ শিক্ষার জন্য ঢাকায় এসে সুনীলের মতো রাত জেগে ফেসবুকিং, ইন্টারনেটে থাকা লোকের সংখ্যা শুধু ১০০ কিংবা ২০০ নয়, হাজার হাজার এবং এ সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েই চলেছে।

ঢাকা শহরে হোস্টেল/মেসে থাকা ছাত্রছাত্রীরা বেশিরভাগই আসে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে। তাদের লক্ষ্য থাকে উচ্চশিক্ষা। কিন্তু উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে গ্রাম থেকে আসা ছেলেমেয়েদের বড় একটা অংশ দূরে সরে যায় মূল লক্ষ্য থেকে। অবাধ স্বাধীনতা পেয়ে অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে তারা। কোনো রকম টেনেটুনে পাস করে শিক্ষা জীবনের ইতি টানছে এ ছেলেমেয়েরা। এ অবস্থা শুধু ঢাকা শহরেই নয়, বাংলাদেশের সব জায়গার চিত্রও প্রায় একই রকম।

আমেরিকান অ্যাডুকেশনাল রিসার্চ অ্যাসোসিয়েশনের বার্ষিক সভায় ওহিয়ো স্টেট ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক যে প্রতিবেদন সাবমিট করেছিল, তাতে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের খারাপ রেজাল্টের চিত্র স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছিল। এরকমের খারাপ রেজাল্টের পেছনে ছিল ফেসবুকসহ জনপ্রিয় সোশ্যাল সাইটগুলোতে আসক্ত হয়ে পড়া। সম্প্রতি জাপান সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক জরিপে স্টুডেন্টদের খারাপ রেজাল্টের পেছনে মোবাইল ডিভাইস নিয়ে সময় ক্ষেপণকেই দায়ী করা হয়েছে।

রাজধানীর একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করেন সাইফুর রহমান। এক ছেলে ও দুই মেয়ের জনক তিনি। ছেলে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করে। সাইফুর রহমান বলেন, ‘ছেলেটা প্রায় সারাদিনই তার মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত থাকে। কখনও ফেসবুক, কখনও কথা বলা আবার কখনও ইন্টারনেট ব্যবহার করে। আজকালের ছেলেমেয়েদের যে কী হল, সব সময়ই মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকে। আমরা যখন ছোট থেকে বড় হয়েছি, তখন খেলাধুলা করতাম, ঘুরতে যেতাম, বন্ধুরা মিলে হৈ-হুল্লোড়, দুষ্টামি করতাম। কিন্তু বর্তমান সময়ের ছেলেরা খেলাধুলা করে না, সারাক্ষণই মোবাইলে ডুবে থাকে।’

তিনি আরও বলেন, এ বয়সে থাকতে আমরা জীবন-জীবিকা, জীবনের নানা স্বপ্ন, পরিকল্পনা কীভাবে বাস্তবায়ন করা যায় তা নিয়ে অনেক কিছু ভাবতাম। গল্প বই, উপন্যাস পড়তাম। কিন্তু এখনকার ছেলেমেয়েরা তাদের বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের মাঝে থাকলেও ফোনে আসক্ত থাকে বেশি। তাদের মধ্য থেকে ক্রিয়েটিভ চিন্তা শক্তি, ক্ষমতা দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। মাত্রাতিরিক্ত স্মার্টফোন ব্যবহারের ফলে এমনটি হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

নিয়মিত স্মার্টফোন ব্যবহারে অভ্যস্ত শিশু-কিশোররা কিছুক্ষণের জন্য এগুলো থেকে দূরে থাকলেই অস্থির হয়ে পড়ে। আর যাদের কাছে এ প্রযুক্তিপণ্যগুলো নেই, আশপাশের কারোরটা দেখলে তাদের মধ্যে জন্ম নেয় হাহাকার আর অপূর্ণতার অনুভূতি। ইন্টারনেট এবং স্মার্ট ডিভাইসের প্রতি আসক্তি নতুন প্রজন্মকে তাদের পরিবার, আত্মীয়, বন্ধু, সমাজ থেকে দূরে নিয়ে যাচ্ছে, সরিয়ে দিচ্ছে সঠিক শিক্ষা ও সুন্দর জীবন থেকে। নিজেকে ও সন্তানকে প্রযুক্তিতে উন্নত করতে গিয়ে বাংলাদেশের প্রত্যেকটা মানুষের অবস্থাও যেন ইন্টারনেটে আসক্ত উন্নত বিশ্বের তরুণ

প্রজন্মের মতো না হয়, সে ব্যাপারে আগে থেকেই সতর্ক থাকা উচিত।

মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, স্মার্টফোন, ইন্টারনেট ব্যবহার ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসক্ত হয়ে পড়ছে এ সমাজ। এতে তাদের শরীরের চেয়ে মানসিক ক্ষতি হচ্ছে বেশি। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) প্রকাশিত গত নভেম্বরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে সক্রিয় মোবাইল ফোন সংযোগের সংখ্যা ১৪ কোটি ছাড়িয়েছে। মোবাইল ফোনের সক্রিয় সংযোগ বা সিমের সংখ্যা ১৪ কোটি সাত লাখ। এ সময়ে মোট ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা সাত কোটি ৯২ লাখ।

এদিকে বড়দের পাশাপাশি ছোটদের মাঝেও প্রযুক্তিপণ্যের ব্যবহার বাড়ছে ক্রমেই। এমনকি বাচ্চাদেরও এতে আশক্তি বাড়ছে। কম্পিউটার, ল্যাপটপ, স্মার্টফোন, ট্যাব, গেমিং ডিভাইস, ইন্টারনেট কোনোটাই তাদের অজানা নয়। বর্তমানে মায়েরা তাদের ছোট শিশুদের ইউটিউবে কার্টুন দেখিয়ে বাচ্চাকে খাওয়ান। এতে করে বাচ্চার মস্তিষ্কের মারাত্মক ক্ষতি হয় এবং এটি নেশায় পরিণত হয়।