ছোটবেলা থেকেই আমার মা আমাকে শেখাতেন ‘মেয়েদের জোরে হাসতে বা কথা বলতে হয় না, মেয়েদের সন্ধ্যা হওয়ার আগেই ঘরে ফিরতে হয়, এই কাজ মেয়েদের না ছেলেরা করে, এতো খেলাধূলা করে কি হবে, মেয়েরা যতো যাই করুক স্বামীর সংসারই একমাত্র পথ, একজন সঠিক জীবনসঙ্গী পাওয়া অনেক জরুরী, বিয়ে না করতে সমাজ উল্টে যাবে ইত্যাদি ইত্যাদি’। আমার মতো হয়তো অনেকেই এই কথা শুনেছেন মায়ের কাছ থেকে। এবং আমি অনেক বেশি নিশ্চিত যে আমাদের মতো নারীরা যারা মায়ের এই আদর্শ মনের মধ্যে লালন করে চলেছেন তারাও তার মেয়েটিকে এই শিক্ষা দিয়েই বড় করবেন।
আমার মা কিন্তু খুব বেশি ব্যাকডেটেড মহিলা নন, তিনি আমাদের দু বোনকে অনেক আদরেই মানুষ করেছেন। তিনি আমাদের সব থেকে ভালো যে শিক্ষা দিয়েছেন তা হচ্ছে মেয়েদের স্বাবলম্বী হওয়া, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মতো দীক্ষা এবং নিজেকে। কিন্তু এই দীক্ষা দেয়ার পরও তিনি বাঁধা পড়ে গিয়েছেন সেই আগের চিন্তায়। এখন হয়তো তিনি বলেন না ‘মেয়েদের জোরে হাসতে বা কথা বলতে হয় না, মেয়েদের সন্ধ্যা হওয়ার আগেই ঘরে ফিরতে হয়’, কিন্তু স্বামী সংসার এবং বিয়ে নিয়ে তার চিন্তাধারা আগের মতোই রয়েছে। আমার মায়ের চিন্তা যে পুরোপুরি অমূলক তা আমি বলছি না, কিন্তু মেয়েদের যে এই সংসার এবং স্বামীর ঘরই শেষ অবলম্বন এই বিষয়টি আমি মানতে একেবারেই নারাজ।
আমার মূল কথা হচ্ছে, যদি মেয়েটিকে শিক্ষা দেয়া হয় স্বামীর ঘরই তোমার অবলম্বন তাহলে মেয়েটি নিজের আত্মপরিচয় গড়ে লাভ কোথায় হচ্ছে। আর এই ধরণের শিক্ষা দিয়ে কি মেয়েটিকে একেবারেই নিজের আত্মমর্যাদা সম্পর্কে ভুল জ্ঞান দেয়া হচ্ছে না? ‘আমি যতো যাই করি না কেন আমার ঠিকানা শুধুই আমার স্বামীর ঘর’- এমন চিন্তাধারার মেয়েটির কাছ থেকে আসলেই কি কিছু আশা করা সম্ভব? যে নারীটি ছোটবেলা থেকেই জেনে আসবেন, সমাজে তার মূল্যায়ন হবে তার স্বামীর পরিচয়ে তখন তিনি নিজের ইচ্ছায় আদৌ কি নিজেকে আত্মবিশ্বাসী করতে পারবেন? আমার মনে হয় না।
মর্যাদা কেউ কাওকে ধরে এসে দিয়ে যায় না, নিজের মর্যাদার স্থান নিজেকেই গড়ে নিতে হয়। আর নারীর মর্যাদা যতোই চাওয়া হোক না কেন যদি ঘর থেকেই না দেয়া যায় তাহলে অন্য পরিবারের আরেকজন এসে মর্যাদা দেবে না। ঘরের পুত্র সন্তানটি যদি দেখতে থাকেন তার বোন অনেক কিছু থেকেই পিছিয়ে রয়েছে তখন বাইরের নারী সম্পর্কে তার ভুল ধারণা জন্মাতেই পারে। সুতরাং শুরুটা ঘরেই হওয়া উচিত।
নিজের পুত্র সন্তানটিকে একেবারে ছেড়ে না দিয়ে একটু সঠিক শিক্ষা দেয়া যেমন জরুরী তেমনই জরুরী নিজের মেয়েটিকে একেবারে বন্দী না করে কিছুটা ছাড় দেয়া। এবং এর জন্য মায়েদেরকেই উদ্যোগী হতে হবে। অন্তত এখনকার নারী যদি নিজের মেয়েকে ছোটো থেকেই কিছু জিনিস শিখিয়ে বড় করতে পারেন তাহলে মেয়েটিকে একজন আত্মমর্যাদা সম্পন্ন, স্বাবলম্বী পূর্ণাঙ্গ নারী হিসেবে গড়ে তুলতে পারবেন।
১) ‘একজন সঠিক জীবনসঙ্গী এবং স্বামীর সংসারই শেষ অবলম্বন নয় মেয়েদের জন্য, নিজে স্বাবলম্বী হওয়া জীবনের অনেক বড় একটি সফলতা’- মানুষ অন্তত বুঝবে মেয়েরাও সবকিছু করতে পারে।
২) ‘সুন্দরী হওয়ার চাইতে বুদ্ধিমতী হওয়া বেশি জরুরী’- এতে অন্তত সুন্দর হওয়ার জন্য মেয়েরা আজকাল যা শুরু করছেন ভবিষ্যতে তা আরও খারাপ অবস্থা ধারণ করবে না।
৩) ‘নারীর লজ্জা থাকা যেমন জরুরী, তেমনই জরুরী নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে জ্ঞান থাকা’- নিজের মর্যাদা নিজে বুঝলে এবং নিজের ক্ষমতার ব্যাপারও না জানলে নারীরা নিজের জন্য ভালো মন্দ দুটোই বিচার করতে পারবেন না।
৪) ‘প্রয়োজনে গলার আওয়াজ ওঠানো নারীদের জন্য জরুরী’- মুখ বুঝে অন্যায় সহ্য করাও একধরণের পাপের পর্যায়ে পড়ে। নিজের কথা বলতে জানলে অন্তত এটা প্রকাশ পেতে থাকবে, মেয়েরাও মানুষ।
৫) ‘তুমি যা ইচ্ছা হতে পারো জীবনে’- নারীকে বলাই হয় শিক্ষিকা, ডাক্তার ও ব্যাংক কর্মকর্তা নারীর জন্য সুবিধাজনক। কিন্তু একজন নারী ক্রিকেটার, ফুটবলারও হতে পারেন তা ভুলে গেলে চলবে না।