আধুনিক হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা ঳কি ভাবে হোমিওপ্যাথি ঔষধ তৈরী করা হয়( ভিডিও)

1
ডাঃ এস.জামান পলাশ

ভারতে হোমিওপ্যাথির যাত্রা ১৮৩৯ সালে। তখন বৃটিশ রাজত্ব। পাঞ্জাবের রাজা রনজিত সিং বাকযন্ত্রের (vocal cord) রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। পক্ষাঘাতজনিত তার বাকযন্ত্রের চিকিৎসা করেন ডা. জন মারটিন হনিগরার্গার। রাজা তার হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় আরোগ্যলাভ করেন। এরপর রাজার পৃষ্ঠপোষকতায় এগিয়ে চলে হোমিওপ্যাথি ভারতবর্ষে। ১৯৩৭ সালে প্রথম সরকারি স্বীকৃতি মেলে কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের মাধ্যমে। ১৯৪৮ সালে পাস হয় হোমিওপ্যাথি শিক্ষা ও চিকিৎসা আইন। এভাবেই ভারতে হোমিওপ্যাথির অগ্রযাত্রা।

মূলত বৃটিশ আমলেই ভারতবর্ষে হোমিওপ্যাথির বিকাশ শুরু হয়েছিল। কারণ বৃটিশ রাজপরিবারই হোমিওপ্যাথির পৃষ্ঠপোষকতা করছিল। আমরা জানি, রাজপরিবারের সদস্য ডক্টর কুইন (Dr. Quin) কলেরা আক্রান্ত হয়ে হোমিওপ্যাথিক ঔষধ ক্যামফর (Camphor) সেবনে আরোগ্যলাভ করেছিলেন। তারপর থেকেই (১৯৩২) তিনি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৫০ সালে তিনি লন্ডনে প্রথম হোমিওপ্যাথিক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। বলা যায় হোমিওপ্যাথি ঔষধের গুণাবলীর কারণে। হোমিওপ্যাথি রাজপরিবারের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিল।
হোমিওপ্যাথি ঔষধের প্রধান উৎস উদ্ভিদ। শতকরা ৭০ ভাগ ঔষধ তৈরি হয় উদ্ভিদ থেকে। এছাড়া উৎস হিসেবে রয়েছে প্রাণীজ, খনিজ এবং রোগজ জীবাণু। হোমিওপ্যাথির প্রথম ঔষধ চায়না (china)। এই চায়নার মাধ্যমেই হোমিওপ্যাথির আবিষ্কার। চায়নার উদ্ভিজ নাম সিঙ্কোনা অফিসিনালিস (cinchona)। এর প্রধান উপাদান কুইনিন (quinine), যা থেকে ম্যালেরিয়া রোগের ঔষধ তৈরি হত। কিন্তু পাকস্থলির সমস্যাসহ বহুবিধ রোগে। হোমিওপ্যাথির পূর্বে ১৭ শতক থেকেই ভেষজ হিসেবে চায়নার ব্যবহার ছিল চিকিৎসা বিজ্ঞানে।
এমনিভাবে যেসব ভেষজ চিকিৎসা বিজ্ঞানে বহুপূর্বে থেকেই ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। সেগুলো থেকেই হোমিওপ্যাথি ঔষধ তৈরি হতে লাগল। যেমন- বেলেডোনা। এক সময় ইতালীর রমণীরা চোখের প্রসাধন হিসেবে এর নির্যাস ব্যবহার করত। বেলেডোনার অর্থ হচ্ছে সুন্দরী রমণী (beautiful woman)। অথচ হোমিওপ্যাথিতে এর ব্যবহার, সংক্রমন, প্রদাহ, ফ্লু, জ্বর, মাথাব্যথা, ইত্যাদি বহুবিধ রোগে।homeopathy
হোমিওপ্যাথির বহুল ব্যবহৃত ঔষধ আর্নিকা মন্টেনা। কেটে গেলে, ছিঁড়ে গেলে, আঘাত পেলে যার দ্বারা দেয়া হয় প্রাথমিক চিকিৎসা। অথচ ভেষজ হিসেবে এর ব্যবহার ষোড়শ শক থেকে। আমাশয়, বাত, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি রোগের ভেষজ ছিল আর্নিকা।
আবার দেখা যায়, মৌমাছি থেকেও ঔষধ তৈরি হয়েছে হোমিওপ্যাথিতে। মৌমাছির মধু ভেষজ হিসেবে ব্যবহৃত হলেও মৌমাছির তেমন কোন ভেষজ ব্যবহার ছিল না। হোমিওপ্যাথিতে এর ব্যবহার রয়েছে, প্রস্রাবে সংক্রমণ, শরীরে পানি জমা, অ্যালার্জি, বাত ইত্যাদি ক্ষেত্রে।
বিষাক্ত সাপের বিষ থেকেও তৈরি হয়েছে হোমিওপ্যাথি ঔষধ। লেকেসিস, ক্রোটেলাস, ইল্যা≈, ন্যাজা, ইত্যাদি অনেক মূল্যবান ঔষধ তৈরি হয়েছে সাপের বিষ থেকে। রোগ জীবাণুর বিশেষ ব্যবহার রয়েছে হোমিওপ্যাথি ঔষধ তৈরিতে যেমন- গণোরিয়ার জীবাণু থেকে তৈরি হয়েছে মেগেরিনাম, সিফিলিসের জীবাণু থেকে সিফিলিনাম, যক্ষ্মার জীবাণু থেকে টিউবারকুলিয়াম ইত্যাদি। এগুলো সবই জীবনরক্ষাকারী মূল্যবান ঔষধ।
হোমিওপ্যাথি ঔষধ শক্তিকৃত। যে পদ্ধতিতে ভেষজ দ্রব্যকে শক্তিকরণ করা হয় তাকে বলা হয় পোটেন্টাইজেশন (potentization)। শক্তিকৃত ঔষধ সুস্থ মানবদেহে পরীক্ষার মাধ্যমে তা ‘মেডিসিন’ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। তাই কোন বস্তু শুধুমাত্র তার ভেষজগুণাবলী থাকলেই হোমিওপ্যাথিতে ঔষধ হিসেবে স্বীকৃতি পায় না। জৈব রাসায়নিক গুণাবলীর দ্বারা কোন উদ্ভিদ বা প্রাণী ভেষজ হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও হোমিওপ্যাথিতে তা ঔষধ হিসেবে স্বীকৃতি পায় না, যতক্ষণ না তা শক্তিকৃত হবে এবং সুস্থ মানবদেহে পরীক্ষিত হবে।homeopathy00000
হারবাল এবং হোমিওপ্যাথি, দুই পদ্ধতিতেই উদ্ভিজ ব্যবহার রয়েছে। যেসব উদ্ভিদ হারবাল পদ্ধতিতে ব্যবহৃত হয় সেগুলো অবিষাক্ত উদ্ভিদ (non-toxic plant)। হোমিওপ্যাথিতে বিষাক্ত উদ্ভিদ থেকেও ঔষধ তৈরি হয়। যেমন- অত্যন্ত বিষাক্ত একটি গাছের পাতা থেকে রাস টক্স (Rhus Toxicodendron) ঔষধটি তৈরি হয়। যার ব্যবহার রয়েছে চর্মরোগ, বাত, ফুসফুস প্রদাহ, টাইফয়েড জ্বর ইত্যাদি বহুবিধ ক্ষেত্রে। এসব অতি বিষাক্ত গাছ-গাছড়ার অধিকাংশই ইউরোপীয়। যেহেতু হোমিওপ্যাথির জন্ম ও বিকাশ ইউরোপ, তাই স্বাভাবিক নিয়মে ইউরোপীয় উদ্ভিদেরই প্রাধান্য থাকবে তার ঔষধে। তাছাড়া ভেষজ উদ্ভিদগুলো বহু আগে থেকেই চিকিৎসা জগতে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। তবে এখন বিভিন্ন দেশে দেশীয় ভেষজ উদ্ভিদ ব্যবহার করে হোমিওপ্যাথিক ঔষধ তৈরি হচ্ছে। এসব দেশের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ভারত। ইতোমধ্যে প্রায় ৩০টি দেশীয় ভেষজ উদ্ভিদ ব্যবহার করে ভারত হোমিওপ্যাথিক ঔষধ তৈরি ও ক্লিনিক্যাল প্রুভিং সম্পন্ন করে তার ফলাফল প্রকাশ করেছে। এসব ঔষধের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, ওলট কম্বল গাছ থেকে অ্যাবরোমা আগাস্টা, বেল ফল থেকে ইগল মারমেলস, বেল পাতা থেকে ইগল ফোলিয়া, নিমের ছাল থেকে অ্যাজাডিরিক্টা ইন্ডিকা, পেপে থেকে ক্যারিকা প্যাপাইয়া, জায়ফল থেকে মাইরিস্টিকা, তেলাকুচা থেকে সেফালেন্ড্রা, দুর্বা ঘাস থেকে সিনোডোন, থানকুনি পাতা থেকে হাইড্রোকটাইল, বাসক থেকে জাস্টিসিয়া, কালোজাম থেকে সিজিজিয়াম, অজুর্ন থেকে টারমিনালিয়া অর্জুনা ইত্যাদি।
এসব দেশীয় ভেসজ উদ্ভিদ থেকে ঔষধ তৈরির গবেষণায় ভারত সরকার প্রচুর অর্থ খরচ করছেন। ১৯৭৮ সাল থেকে ভারত সরকার সেন্ট্রাল কাউন্সিল ফর রিসার্চ ইন হোমিওপ্যাথি (Central council for Research is Homeopathy) পরিচালনা করছেন। এছাড়া বহুমুখী গবেষণা কার্যক্রমও পরিচালনা করছে তারা। হোমিওপ্যাথিক ফার্মাকোপিয়া কমিটি (১৯৬২ সালে গঠিত) কর্তৃক ভারতীয় হোমিওপ্যাথিক ফার্মাকোপিয়া প্রকাশিত হচ্ছে নিয়মিত। সরকারি পর্যায়ে ঔষধ তৈরির জন্য রয়েছে ‘‘হোমিওপ্যাথিক ফার্মাকোপিয়া ল্যাবরেটরি (গাজিয়াবাদ)’’। এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হোমিওপ্যাথি, কলকাতা, কর্তৃক পরিচালিত হচ্ছে শিক্ষা ও গবেষণা উন্নয়ন কার্যক্রম। এমনকি ভারত সরকার তাদের উপজাতীয় অঞ্চলে ২২টি গবেষণা ইউনিট পরিচালনা করছে হোমিওপ্যাথির উপর।
ক্লিনিক্যাল রিসার্চ-এর আওতায় এইচআইভি/এইডস, অ্যাজমা, ফাইলেরিয়া, ম্যালেরিয়া, হাইপারটেনশন, আর্থ্রাইটিস, ডাইটিলিগো, ইপিলে≈x, ডায়াবেটিস ইত্যাদি বহু দুরারোগ্য ব্যাধি নিয়ে হোমিওপ্যাথিক ঔষধের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পরিচালিত হচ্ছে।
উপরোক্ত গবেষণা তথ্য তুলে ধরার উদ্দেশ্য হচ্ছে, আমাদের সরকার প্রতিবেশী বন্ধু দেশ ভারতকে মডেল বিবেচনা করে বাংলাদেশেও যাতে হোমিওপ্যাথিক ঔষধের গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেন। বর্তমান বিশ্বে সম্ভবত একমাত্র ভারত সরকারই হোমিওপ্যাথির উন্নয়নে ব্যাপক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছেন। বিশেষভাবে দারিদ্র্যপীড়িত ভারতের ব্যাপক জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার মানসেই তারা হোমিওপ্যাথির উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন। আমাদের দেশের জনগণও দারিদ্র্যপীড়িত। অর্থনৈতিক কারণে তাদের অনেকেই চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। হোমিওপ্যাথির মত উন্নত এবং স্বল্প খরচের চিকিৎসা পদ্ধতির যথাযথ উন্নয়ন হলে দেশের জনগণ ব্যাপকভাবে উপকৃত হবেন। আমরা জানতে পেরেছি, বর্তমান সরকার হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার উন্নয়ন পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ যদি বৃটেন এবং ভারতকে হোমিওপ্যাথির উন্নয়ন মডেল বিবেচনা করে পরিকল্পনা গ্রহণ করেন তাহলে দেশ ও জাতি উপকৃত হতে পারবে। তবে এ ব্যাপারে সরকারি হোমিওপ্যাথিক ডিগ্রি কলেজ ও হাসপাতালটিকে উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু বিবেচনা করা দরকার। কলেজে নিয়মিত বিএইচএমএস শিক্ষক নিয়োগ এবং তাদের জন্য উচ্চতর প্রশিক্ষণ কিংবা পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিগ্রি অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি করা দরকার। উচ্চতর ডিগ্রি ছাড়া মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রদান কঠিন কাজ। তাই শিক্ষকদের উচ্চতর ডিগ্রির বিষয়টি সরকারকে আন্তরিকভাবে বিবেচনা করা দরকার। হোমিওপ্যাথিক গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার বিষয়টি ত্বরান্বিত হওয়া প্রয়োজন। হাসপাতালটিকে আরও মানসম্পন্নভাবে পরিচালনার উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজটি এদেশের প্রথম ডিগ্রি কলেজ হিসেবে স্বীকৃত। তাই এ কলেজটিকে সরকারিকরণ করা দরকার। ডিপ্লোমাপ্রাপ্ত চিকিৎসকদের নিয়ে চিন্তা করতে হবে। কারণ হাজার হাজার ডিএইচএমএস চিকিৎসক রয়েছে এদেশে। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সরকার এদেরকে কাজে লাগালে দেশ উপকৃত হবে। আমাদের বিশ্বাস, হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকদের যথাযথভাবে মূল্যায়ন করলে দেশের স্বাস্থ্যসেবায় ব্যাপক পরিবর্তন আসবে।

 হোমিওপ্যাথি ঔষধ কিভাবে বানানো হয় দেখুন। 

****************************************

প্রভাষক.ডাঃ এস.জামান পলাশ
জামান হোমিও হল
01711-943435 //01670908547
চাঁদপুর হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল
ওয়েব সাইট –www.zamanhomeo.com

( প্রতি মুহুর্তের চিকিৎসা বিষয়ক খবর গুলো নিয়মিত পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিন ) https://www.facebook.com/ZamanHomeoHall

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *