জরায়ুমুখ ক্যান্সার **** সতর্ক থাকলে সমাধান মেলে

1

জরায়ুমুখ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় নারীরা, কিন্তু রোগটি আসে সাধারণত পুরুষের মাধ্যমে। এতে মৃত্যুহারও বেশি। অথচ একটু সচেতন হলে এড়ানো যায় এই ক্যান্সার।

রোগটি সম্পর্কে অজ্ঞতা জরায়ুমুখ ক্যান্সারের অন্যতম কারণ। আক্রান্ত হওয়ার পর মৃত্যুমুখে পতিত হওয়ার কারণও অজ্ঞতা। লজ্জায় অনেকে রোগটি লুকিয়ে রাখেন, বাসা বাঁধতে থাকে ক্যান্সার। চিকিৎসাসম্পর্কিত ধারণা ও চিকিৎসাসংক্রান্ত সুযোগ-সুবিধার অভাবেও এমনটি হয়। অথচ সচেতন হলেই জরায়ুমুখ ক্যান্সার থেকে মুক্ত থাকা যায় এবং প্রতিরোধও করা যায়।
চলতি জানুয়ারিকে পালন করা হচ্ছে আন্তর্জাতিক জরায়ুমুখ ক্যান্সার সচেতনতা মাস হিসেবে। উদ্দেশ্য, রোগ ও তার প্রতিরোধ সম্পর্কে জানা ও নিজেকে মুক্ত রাখা।2

বিশ্বজুড়েই জরায়ুমুখ ক্যান্সার আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। বাংলাদেশেও তাই। পরিসংখ্যান বলে-

* বাংলাদেশে জরায়ুমুখ ক্যান্সারের প্রকোপ অনেক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর সাড়ে ১৭ হাজারেরও বেশি (১৭ হাজার ৬৮৬ জন) নারী নতুন করে জরায়ুমুখ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়।

* বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে ২৮ জন নারীর মৃত্যুর কারণ জরায়ুমুখ ক্যান্সার।

* উন্নত দেশগুলোতে ৮০ ভাগ ক্ষেত্রে প্রাথমিক পর্যায়েই রোগটি শনাক্ত হয়। তাই সেখানে রোগ থেকে আরোগ্য লাভের হার অনেক বেশি।

* বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ৮০ ভাগ ক্ষেত্রে রোগটি নির্ণিত হয় অনেক দেরিতে, তাই এখানে আরোগ্য লাভের হার তুলনামূলকভাবে কম।
অন্যান্য ক্যান্সারের তুলনায় জরায়ুমুখ ক্যান্সার হতে একটু বেশি সময় নেয়। জরায়ুমুখের স্বাভাবিক কোষগুলো ক্যান্সার কোষে রূপান্তর হতে ১০ থেকে ২০ বছরও সময় নেয়। ক্যান্সার কোষে রূপান্তর হওয়ার পর অবশ্য রোগটি দ্রুত বাড়তে থাকে। কখনো কখনো এটি পিণ্ডের আকার ধারণ করে, কখনো কখনো এক ধরনের ঘা তৈরি করে। এ সময় ওই স্থান থেকে রক্তক্ষরণও হয়।

জরায়ুমুখ ক্যান্সারের লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে-4

* মাসিকের পাশাপাশি মাসিকের রাস্তায় অনিয়মিত রক্তক্ষরণ। অনেকে এটাকেও মাসিক মনে করে ভুল করেন।

* যাদের মাসিক ইতিমধ্যে বয়সের কারণে বন্ধ হয়ে গেছে, তাদের ক্ষেত্রে মাসিক বন্ধ হওয়ার পরও মাসিকের রাস্তা দিয়ে রক্ত যাওয়া।

* সহবাসের পর রক্তক্ষরণ।

* জরায়ুমুখে স্পর্শ মাত্রই সেখান থেকে রক্তক্ষরণ হতে থাকে।

* কোনো ধরনের ইনফেকশনের কারণে মাসিকের রাস্তা দিয়ে সাদা ও ঘন অথবা বাদামি রঙের দুর্গন্ধযুক্ত তরল স্রাব নিঃসরণ।

* তলপেটে ব্যথা হতে পারে।

জরায়ুমুখ ক্যান্সারের খুব দুর্ভাগ্যজনক দিক হলো-625441_570364346315944_1401795330_n

* রোগটি ক্যান্সারে রূপান্তর হওয়ার আগে সাধারণত কোনো লক্ষণই প্রকাশিত হয় না। তাই রোগীও সহজে বুঝতে পারে না।

* সাধারণত রোগী যখন ডাক্তারের কাছে আসে তত দিনে ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়ে বা রোগটি বিস্তৃত হয়।

* ক্যান্সারে রূপান্তর হওয়ার পর তা খুব দ্রুত জরায়ুর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তখন অস্ত্রোপচার ও রেডিওথেরাপি ছাড়া কোনো চিকিৎসা থাকে না।

* মাত্র একবার যৌন মিলনেই যেকোনো নারী এই রোগের ভাইরাস, হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস বা এইচপিভি দিয়ে আক্রান্ত হতে পারে।

* অন্যান্য যৌনবাহিত রোগের মতো জরায়ুমুখ ক্যান্সার কনডম ব্যবহারেও পুরোপুরি প্রতিরোধযোগ্য নয়। কারণ এ ভাইরাস সংক্রমণ যৌনাঙ্গ স্পর্শেও হতে পারে।

* প্রতি পাঁচজন নারীর মধ্যে চারজনই কোনো না কোনোভাবে জরায়ুমুখ ক্যান্সারের জীবাণু এইচপিভি দিয়ে আক্রান্তের ঝুঁকিতে থাকে।
তবে জরায়ুমুখ ক্যান্সারের কয়েকটি দিক আবার রোগটি সহজেই নির্ণয় ও চিকিৎসার জন্য কাজে আসে।3

* প্রাথমিক পর্যায়ে খুব ধীরগতিতে সৃষ্টি হয়, তাই নিয়মিত পরীক্ষা করালে অল্প খরচেই শনাক্ত ও চিকিৎসা করা যায়।

* জরায়ুমুখ খুব সহজে ও অল্প সময়েই দেশের প্রায় সব সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পরীক্ষা করা যায়। সাধারণ চিকিৎসকরাও এ পরীক্ষা করতে পারেন।

* বেশির ভাগ এইচপিভি রোগ তৈরি করার আগেই শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার মাধ্যমে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।

জরায়ুমুখ ক্যান্সারের কারণ1604424_594459220622158_1199811470_n

* হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস বা এইচপিভি দিয়ে ৯৯ শতাংশ জরায়ুমুখ ক্যান্সার হয়। এই ভাইরাসটি আবার যোনিপথ, যৌনাঙ্গ, পুরুষাঙ্গ, স্ক্রোটাম, মুখ ও গলার ক্যান্সারের জন্যও অন্যতম দায়ী।

* সাধারণত পুরুষ এই ভাইরাসের বাহক। যৌন মিলনের সময় ভাইরাসটি নারীর শরীরে সংক্রমিত হয়। তবে যৌন মিলন ছাড়াও জননাঙ্গের স্পর্শেই ভাইরাসটি ছড়াতে পারে। এমনকি পুরুষ-পুরুষ, নারী-নারী যৌন সংস্পর্শও ভাইরাসটি ছড়ানোর মাধ্যম।

* যাঁরা ধূমপান, তামাক ও তামাকজাত পণ্য সেবন করেন, যেমন পানের জর্দা, সাদাপাতা, গুল ইত্যাদি; যাঁরা দীর্ঘদিন জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি সেবন করেন, যাঁরা অপুষ্টিতে আক্রান্ত, যাঁরা ঘন ঘন সন্তান ধারণ করেন, যাঁদের জরায়ুতে অন্য কোনো ইনফেকশন আছে বা যাঁরা এইচআইভি বা এইডস আক্রান্ত, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় এমন রোগে যাঁরা আক্রান্ত
তাঁদের জরায়ুমুখ ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বেশি।

* এ পর্যন্ত ১১০-র মতো এইচপিভি ভাইরাসের ধরন শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৭০ শতাংশই জরায়ুমুখ ক্যান্সারে পড়ে না। সাধারণত এইচপিভি ১৬ ও এইচপিভি ১৮ দুটি ভাইরাস জরায়ুমুখ ক্যান্সারের জন্য বেশি দায়ী। এ ছাড়া এইচপিভি ৩১, এইচপিভি ৩৩ ও এইচপিভি ৪৫ থেকেও কিছু জরায়ুমুখ ক্যান্সার হয়।

জরায়ুমুখ ক্যান্সার প্রতিরোধMithila-15

* জরায়ুমুখ ক্যান্সার প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকর ব্যবস্থা টিকা। দ্বিতীয় কার্যকর ব্যবস্থা যথাসময়ে ভায়া বা প্যাপস্মিয়ার পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্তকরণ বা স্ক্রিনিং।

* নারী ও পুরুষ উভয়েই টিকা গ্রহণ করতে পারে।
* টিকা নিলে শরীরে এইচপিভির বিরুদ্ধে কার্যকর অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, যা ভাইরাসটি শরীরে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে কার্যকর হয়ে তাকে ধ্বংস করে দিতে সক্ষম।
* জরায়ুমুখ ক্যান্সার প্রতিরোধের টিকা সারভারিক্স দেশে পাওয়া যায়। নিকটস্থ গাইনি ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে এই টিকা গ্রহণ করা যেতে পারে। এই টিকা সূর্যের হাসি চিহ্নিত ক্লিনিক, মেরিস্টোপস্ ক্লিনিক, বড় হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারেও পাওয়া যায়।
এই টিকাটি ৯ বছর বয়স থেকে নারীকে দিতে হয়। এটির তিনটি ডোজ, প্রথম নেওয়ার এক মাস পর দ্বিতীয় ডোজ এবং ছয় মাস পর তৃতীয় ডোজ। এই টিকা হাতের মাংসপেশিতে দিতে হয়।
* সাধারণত ৯ থেকে ১৫ বছর বয়সের মধ্যে টিকা গ্রহণ করা ভালো। এ বয়সে শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হওয়ার হার অন্য বয়সের চেয়ে বেশি থাকে।
* যৌন সক্রিয় নারীদের নিয়মিত ভায়া বা প্যাপস্মিয়ার টেস্ট করাতে হবে।
* অল্প বয়সে বিয়ে ও বেশি সন্তান গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
* তামাক ও তামাকজাত পণ্যের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং অপুষ্টিজনিত রোগ থেকে মুক্ত থাকতে পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *