তের-চৌদ্দ বছর বয়সের কিশোরীর সমস্যা এর মুক্তি সবার সচেতনতায়

1389480548.
ডাঃ এস.জামান পলাশ

তের-চৌদ্দ বছর বয়সের একজন কিশোরীর অনেক সমস্যা থাকে। এসব সমস্যার মধ্যে এমন কিছু সমস্যা রয়েছে যেগুলো লজ্জায় বলা হয়ে ওঠে না। যৌবনপ্রাপ্তির বয়সে কিশোরীর শারীরিক কিছু পরিবর্তন সূচিত হয়, যার ফলে শুরু হয় মিনস্ট্রুয়েশন। মিনস্ট্রুয়েশন, মাসিক, ঋতুস্রাব বা পিরিয়ড এগুলো সবই একই অর্থ বোঝায়। একটি মেয়ের পিরিয়ড শুরু হওয়া মানেই দৈহিকভাবে নারীত্বের বিকাশ শুরু হওয়া। হঠাত্ করে পিরিয়ডের আবির্ভাবে কিশোরীর মনে ভয় লাগতে পারে। যদিও এগুলো খুবই স্বাভাবিক এবং কাঙ্ক্ষিত বিষয় এবং জীবনধারারই অঙ্গ।
সাধারণভাবে ২৮ দিন পরপর অর্থাত্ একটা নির্দিষ্ট পিরিয়ড বা সময় পরপর এই বিষয়টি দেখা দেয় বলে আধুনিক সমাজে এর শোভনীয় নাম পিরিয়ড। প্রথমদিকে পিরিয়ডে কিছুটা অনিয়ম দেখা দিলেও সাধারণভাবে তিন থেকে পাঁচ দিন পর্যন্ত পিরিয়ডের রক্তক্ষরণকে স্বাভাবিক বলে ধরে নেওয়া হয়। তবে এ ব্যাপারে জনে-জনে ব্যতিক্রম লক্ষ্যণীয়। পিরিয়ডের রক্তে থাকে জরায়ুর একটি স্তর, জরায়ুমুখ থেকে নিঃসরিত তরল, জরায়ুস্তরের মৃত কোষ এবং ব্যাকটেরিয়া। ব্যাকটেরিয়া বা জীবাণুর উপস্থিতির ফলে এর একটি বিশেষ দুর্গন্ধ রয়েছে। পিরিয়ডের জন্য মোটামুটিভাবে ৩৫ থেকে ৪৫ মিলিলিটার রক্ত হারাতে হয়। এই রক্তের পরিমাণ ৫ মিলিলিটার থেকে ৪০ মিলিলিটার পর্যন্ত হতে পারে। পিরিয়ড হওয়া মেয়েদের একটি অতি স্বাভাবিক ব্যাপার। এ সময়ে উদ্ভূত শারীরিক সমস্যাকে মেনে নিতে হবে, স্বাভাবিক জীবন-যাপনে নিজেকে অভ্যস্ত করতে হবে। 479895_511649725537678_791009960_n
কিন্তু পিরিয়ড নিয়ে শত বছর ধরে বিরাজমান সঙ্কোচের কারণে পিরিয়ডের দিনগুলোতে অধিকাংশ নারী অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করছেন। শুধু কিশোরীই নয়, সার্বিকভাবে দেখা গেছে শতকরা ৯৫ ভাগ নারী অজ্ঞতা ও লজ্জার বশবর্তী হয়ে যুগ যুগ ধরে পিরিয়ডের সময় পুরনো কাপড়, টিস্যু কিংবা তুলো ব্যবহার করে আসছেন। ফলে নারী প্রতিনিয়ত আক্রান্ত হচ্ছেন এমন কিছু রোগ কিংবা সমস্যায় যেগুলোর কথাও সহসা মুখ ফুটে বলা হয় না। সেইসব রোগের মধ্যে রয়েছে, জরায়ুমুখের প্রদাহ, জননপথের ব্যথা-চুলকানি, দুর্গন্ধসহ নানাবিধ মেয়েলি রোগ। এছাড়া চলাফেরার অসুবিধা এবং হঠাত্ অসাবধানতাবশত রক্তক্ষরণ পরিধেয় বস্ত্র ভেদ করে দৃশ্যমান হওয়ার টেনশন তো রয়েছেই। স্কুলগামী মেয়েদের মধ্যে পরিচালিত এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, শতকরা ৫৩ ভাগ মেয়ে পিরিয়ডের দিনগুলোতে স্কুল কামাই দিয়ে থাকে। আর যারা পিরিয়ড চলার সময়ে স্কুলে যায় তাদের শতকরা ৪৫ ভাগ এ সংক্রান্ত টেনশন, দুশ্চিন্তার কারণে ক্লাসে মনোযোগ দিতে ব্যর্থ হয়। 199368_469016593138656_618583568_n
বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার মতে, জনন বা যোনীপথের শতকরা ৬২ ভাগ সমস্যার পেছনে পিরিয়ডের সময়ে ব্যবহূত অজীবাণুমুক্ত-অস্বাস্থ্যকর আটসাটহীন উপকরণকে ন্যাপকিন হিসেবে ব্যবহারকে দায়ী বলে মনে করা হয়। প্রচলিত পুরনো কাপড়, তুলো, টিস্যু ইত্যাদির সমন্বয়ে তৈরি অনিরাপদ উপকরণ ব্যবহারের ফলে শতকরা ৭৫ ভাগ নারী পিরিয়ডকালীন চুলকানি এবং ব্যথায় আক্রান্ত থাকে। অথচ এ সমস্যার সহজ সমাধান হচ্ছে মানসম্মত স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করা। শুধু স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার না করার কারণে শতকরা ৯৭ ভাগ নারী পিরিয়ডকালীন জরায়ুমুখের প্রদাহের শিকার হন। ফলে দেখা দেয় জরায়ুমুখের অস্বস্তি, জরায়ুমুখ বেয়ে তরল পদার্থের অস্বাভাবিক নিঃসরণ, এমনকি বন্ধ্যত্বও দেখা দিয়ে থাকে। মানসম্মত স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করে এ সময়ে সহজেই স্বাভাবিক কাজকর্ম করা যায়, এমনকি খেলাধুলাও করা সম্ভব। কিন্তু অধিকাংশ নারী এই পরিসংখ্যান না জানলেও পিরিয়ডজনিত ভোগান্তির বিষয় সম্পর্কে যে তারা অবগত নন তা কিন্তু নয়। তারপরও দেখা যায়, আমাদের দেশে স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারের হার শতকরা ছয়ভাগেরও কম। অধিকাংশরাই হাতের কাছে প্রাপ্ত পুরনো কাপড় কিংবা একটু সচেতন হলে তুলো ব্যবহার করে থাকেন। এর অন্যতম কারণ পিরিয়ড সম্পর্কিত সঙ্কোচ এবং অসচেতনতা। শুধু লজ্জার কারণে সচেতন হওয়ার পরও মেয়েরা পুরুষ দোকানির কাছে স্যানিটারি ন্যাপকিন চাইতেও ইতস্তত বোধ করেন। তারপরও নিজের স্যানিটারি ন্যাপকিন কেনার মতো সাহসী মেয়েরাও পাড়ার পরিচিত দোকান থেকে স্যানিটারি ন্যাপকিন না কিনে, কেনেন দূরের অন্য কোনো দোকান থেকে, যেখানে তাকে কেউ সহজে চিনতে পারবে না। আমাদের দেশে মিনস্ট্রুয়েশন বা পিরিয়ড নিয়ে কথা বলা যেন একটা নিষিদ্ধ বিষয়। অনেক সময় মাও মেয়ের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলতে বিব্রতবোধ করেন। ভাই কিংবা বাবার কথা বলা তো প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। এমনকি ভাই কিংবা বাবার সামনে টিভিতে স্যানিটারি ন্যাপকিনের বিজ্ঞাপন চলে এলে মেয়েরা চ্যানেল ঘুরিয়ে অন্যত্র চলে যায়। আমাদের দেশে এমন কোনো ভাই পাওয়া যাবে না, যাকে বোনের স্যানিটারি ন্যাপকিন কেনার জন্য তাকে কেউ অনুরোধ করেছে। এটা না হয় বাদই দিলাম কিন্তু এমন কোনো স্ত্রী কি পাওয়া যাবে, যিনি তার কন্যার জন্য স্যানিটারি ন্যাপকিন আনার জন্য স্বামীকে অনুরোধ করেছেন? নিশ্চয়ই না। স্যানিটারি ন্যাপকিন কেনার বিষয়টি এতটাই বিব্রত ও অস্বস্তিকর যে, আর্থিক সঙ্গতি থাকার পরও পিরিয়ডকালীন সম্যক অসুস্থতা এবং সুবিধার কথা বিবেচনা করা সত্ত্বেও শুধু লজ্জা বা সঙ্কোচের কারণে অনেকেই এটি সংগ্রহ করতে পারছেন না। ফলে আমাদের নারীদের শতকরা ৯৭ ভাগ প্রতিমাসেই ভুগছেন জননপথের নানা অস্বস্তি ও অসুস্থতায়। সেইসঙ্গে স্বাভাবিক চলাফেরায়ও রয়েছে বাধাগ্রস্থতা। সমাজের এই অস্বস্তি ও ইতস্ততা অতিক্রম করার সময় এসেছে। নারী জীবনের স্বাভাবিক ও কাঙ্ক্ষিত সেই দিনগুলোকে স্বস্তি ও স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে দিতে এগিয়ে আসতে হবে পরিবারকেই। এ বিষয়ে নারীকে সাহসী ও সচেতন করে তুলতে হলে মা-বাবা-ভাই সবাইকেই আলোকিত হবে আধুনিকতা ও জ্ঞানের আলোয়। নারীর নিয়মিত কর্মচাঞ্চল্য ও দৈনন্দিন স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে এর কোনো বিকল্প নেই।

========================================

ডাঃ এস.জামান পলাশ
জামান হোমিও হল
01711-943435
ওয়েব সাইট –www.zamanhomeo.com
ব্লগ–https://zamanhomeo.com/blog
ফেসবুক–https://www.facebook.com/ZamanHomeoHall

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *