বাতজ্বর নিরাময়ে——–2

বাতজ্বর নিরাময়ে
2
ডাঃ এস.জামান পলাশ

রিউম্যাটিক ফিভার এক ধরনের ইনফ্লামেটরি ডিজিজ। গ্রুপ ‘এ’ হিমোলাইটিক স্ট্রেপ্টোককাস ব্যাক্টেরিয়া থেকে স্কারলেট ফিভার বা স্ট্রেপ থ্রোট জাতীয় ইনফেকশন হয় যার থেকে রিউম্যাটিক ফিভার হতে পারে। বাতজ্বর হতে হৃদপিণ্ডের এন্ডোকার্ডিয়ামের (অন্তর্দেশ আবরক ঝিল্লির) প্রদাহ হয়ে থাকে। হৃদপিণ্ডের উপসর্গ সবসময়ই দেখা যায় এবং এটি অত্যন্ত ব্যাপক।
রোগের কারণ: ভিটামিন সি’র অভাব এবং ‘হিমোলাইটিক স্ট্রেপ্টোককাস’ জীবাণুর আক্রমণ এর মূলীভূত কারণ। কেউ কেউ মনে করেন রক্তের মধ্যে ইউরিক অ্যাসিড উৎপন্ন হয়ে সন্ধিতে জমলে বাতজ্বর হয়ে থাকে। হেমন্ত ও শীত ঋতুতেই এর প্রাদুর্ভাব হয় এবং আর্দ্র আবহাওয়া স্যাঁতসেঁতে স্থানে বাস, বৃষ্টিতে ভেজা প্রভৃতি এর প্রবণতা বৃদ্ধি করে। যুবকরাই এই রোগে অধিক সংখ্যায় আক্রান্ত হলেও স্ত্রী-পুরুষ ও বয়স নির্বিশেষে সকলেই এতে আক্রান্ত হতে পারে। এর পুনরাক্রমণ প্রবণতা খুব বেশি এবং তরুণ সর্দির পর প্রায়ই পুনরাক্রমণ হয়। সর্দির স্রাবের সাথে বীজাণু বাহিত হয়ে রোগ বিস্তারে সহায়তা করে। প্রায়ই বংশানুক্রমে এই রোগের প্রবণতা দেখা যায়। এর আক্রমণে হৃদ পেশীর সংযোগ-তন্তু সমূহের অপকর্ষতা ঘটিয়ে তার বিস্তৃত স্ফীতি ও তন্মধ্যে শ্বেতরক্ত কণিকার প্রবেশ ঘটে। হৃদ্বেষ্ট ঝিল্লির এবং বিশেষতঃ হৃদ-উর্ধ্বকোটরের উপর তন্তু সঞ্চয় হয় এবং গ্রন্থিমধ্যে দ্রুত রস সঞ্চয় ঘটিয়ে তত্রস্থ ক্ষুদ্র চেতনাবহ স্নায়ু সমষ্টির উপর চাপ দিয়ে দুরন্ত বেদনা সৃষ্টি করে। নানা প্রকার বাতরোগের মধ্যে এটি সর্বাপেক্ষা মারাত্মক ব্যাধি।
ডা. ন্যাস তাঁর একটি প্রবন্ধে ডা. বরার্টস এর নাম উল্লেখ করে বলেছেন, ‘রক্তে কোনো রকম দূষিত পদার্থের বিদ্যমানতা বাতজ্বরের প্রধান সাময়িক কারণ। এই দূষিত পদার্থ ল্যাকটিক অ্যাসিড বলে মনে করা হয়। পরিপাক এবং পরিপোষন ব্যবস্থার গোলযোগে এটি উদ্ভুত হয়। এই অ্যাসিড রক্তে পাওয়া যায় কি না সে বিষয়েও সন্দেহ আছে।’
ডা. ন্যাস অবশেষে বলেছেন, ‘আমার বিশ্বাস বাতজ্বরের প্রকৃত কারণ কি তা আমরা জানি না এবং এই ‘না জানা’র মত পোষণ করাই সমীচীন বলে মনে হয়। এটি নাতিশীতোষ্ণ এবং আর্দ্র প্রদেশের ব্যাধি। পরিবর্তিত ঋতু বাতরোগের পক্ষে বিশেষ অনিষ্টকর, সুতরাং জলবায়ু এবং ঋতুর প্রভাব ও এই ব্যাধির কারণে বিশেষভাবে দৃষ্ট হয়ে থাকে। বাত ধাতুবিশিষ্ট ব্যক্তিদের সন্ধিতে আঘাত লাগলে অথবা তা মটকাইয়ে গেলে তারা বাতজ্বরগ্রস্থ হয়ে থাকে। ঋতুভেদে এই ব্যাধি কম বেশি হয়ে থাকে। জানুয়ারি হতে এপ্রিল মাস পর্যন্ত সর্বাপেক্ষা এই রোগে আক্রান্তের হার বেশি। তবে ভিন্ন-ভিন্ন দেশে ভিন্ন-ভিন্ন ঋতুতে এই ব্যাধির আবির্ভাব হতে পারে।
যারা এই রোগে বেশি আক্রান্ত হয়: সাধারণত ৫ থেকে ১৫ বছরের বাচ্চারা বাতজ্বরে অধিক পরিমাণে আক্রান্ত হতে দেখা যায় কিন্তু ২ বৎসরের নিচে দুগ্ধপোষ্য শিশুদের মধ্যে এটি কখনও দেখা যায় না। শিশু হতে বৃদ্ধ, সর্ব বয়সের হিসাব নিলে দেখা যায় স্ত্রী অপেক্ষা পুরুষেরাই অধিকতর আক্রান্ত হয়ে থাকে কিন্তু তরুণ বয়স্কদের মধ্যে পুরুষ অপেক্ষা স্ত্রীলোকেরাই এই ব্যাধিতে অধিক পরিমানে ভুগে থাকে। ৫ বৎসর বয়স হতে যৌবনের প্রথম উন্মেষ পর্যন্তও কত রোগী আক্রান্ত হয় এবং ২০ হতে ৩০ বৎসর পর্যন্ত কম রোগীকে আক্রান্ত হতে দেখা যায় কিন্তু ৪ বৎসরের নিচে এবং ৩০ বৎসরের উপরেও এই রোগের প্রাথমিক আক্রমণ কখনও কখনও দৃষ্ট হয়। কেউ কেউ বলেন এই ব্যাধি পৈতৃক, পিতৃপুরুষের থাকলে সন্তানেরও হয়ে থাকে। আবার অনেকে বলেন, এটি অনুমান মাত্র, এ উক্তি কখনও সত্য নয়। নিউমোনিয়ার মত এই ব্যাধি একবার হলে পুনঃপুনঃ হবার সম্ভাবনা থাকে।
রোগের লক্ষণ: এটি জ্বরসহ শরীরের ছোট বড় বিশেষত বড় বড় সন্ধিগুলো প্রদাহিত করে। তীব্র বেদনা আরক্ততা ও স্ফীতি এর প্রধান লক্ষণ। কয়েকদিন শারীরিক অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ হয়ে তারপর হঠাৎ ১০২ ডিগ্রি থেকে ১০৪ ডিগ্রি পর্যন্ত জ্বর ও ক্ষেত্র বিশেষে অল্পাধিক তীব্র বেদনাসহ একটি বা ততোধিক গ্রন্থি স্ফীত ও লাল হয়ে ওঠে। সাধারণত প্রথমে জানু বা গুলফ সন্ধি আক্রান্ত হয় এবং পর্যায়ক্রমে স্কন্ধের, কনুই, হাতের কব্জি, উরু-সন্ধি ও হস্তপদের ছোট ছোট সন্ধিগুলোও আক্রান্ত হয়। প্রথমাক্রমণের জ্বর কয়েক দিনের মধ্যে হ্রাসপ্রাপ্ত হলে পূর্বাক্রান্ত সন্ধির বেদনাও স্ফীতির উপশম ঘটে কিন্তু জ্বর পুনরায় বেগ দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্য একটি বা কয়েকটি গ্রন্থি আক্রান্ত হয়। জিহ্বা আবরণযুক্ত, ঘোরবর্ণ, স্বল্প ও ইউরেটযুক্ত মূত্র, অম্লগন্ধযুক্ত প্রভূত ঘাম, কোষ্টবদ্ধতা ইত্যাদি এবং পাঁজরের সন্ধি আক্রান্ত হলে শ্বাস-প্রশ্বাসে, এমনকি পরনেও বিশেষ কষ্ট অনুভব হয়। টনসিলের প্রদাহ প্রায়ই বর্তমান থাকে। রক্তের শ্বেতকনিকা অত্যধিক বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়। হৃদপিণ্ডের লক্ষণাবলীই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। প্রায় সমুদয় ক্ষেত্রেই হৃদপেশীর প্রদাহ হয়ে নাড়ি দ্রুত, কোমল ও পূর্ণ হয়। হৃদকোটরগুলোর সম্প্র্রসারণ এবং হৃদপিণ্ডের ধ্বনিসহ মৃদু মর্মরধ্বনি শোনা যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এন্ডোকার্ডাইটিস বর্তমান থাকে। শিশুদের এই রোগ উপস্থিত হলে জ্বর ও সন্ধি আক্রমণ প্রবল না হয়ে হস্তপদাদি, উদর ও পাঁজর পেশীর সতীব্র বেদনাসহ হৃদপিন্ড আক্রমণের প্রবণতা বৃদ্ধি পায় এবং মস্তকের উপর, অংস ফলকাস্থির প্রান্ত, হাতের কব্জি, কনুই এর পার্শ্ব প্রভৃতি স্থানে কঠিন ও বেদনাযুক্ত পিণ্ডাদির উদ্ভব হয়। এগুলোকে বাতপিণ্ড বলা হয়। চামড়ার নিচে রক্তস্রাব ও চামড়ার উপর আমবাত প্রকাশ পেতে পারে।
সম্ভাব্য জটিলতা: যদি ঠিকমত রোগ নির্ণয় না হয় তাহলে ভবিষ্যতে অনেক সমস্যা দেখা দিতে পারে। হার্টের ভালভ নষ্ট হয়ে গিয়ে নানা উপসর্গ যেমন বুকে ব্যথা, এমনকি হার্ট ফেলও হতে পারে। অনেক সময় কিডনি আক্রান্ত হয়ে কিডনি ফেলও হয়। পরবর্তীকালে চলাচলজনিত সমস্যাও হতে পারে। হাত-পা এবং শরীর কাঁপতে থাকে। এই সমস্যাকে সিডেনহ্যাম কোরিয়া বলা হয়।
হোমিওপ্যাথিক প্রতিবিধান: রিউম্যাটিক ফিভার বা বাতজ্বর নিরাময়ে হোমিওপ্যাথিতে অভ্যন্ত ফলদায়ক ওষুধ আছে। লক্ষনভেদে নির্দিষ্ট মাত্রায় ওষুধ প্রয়োগ করে এই রোগ সম্পূর্ণভাবে আরোগ্য করা সম্ভব। এই রোগে ব্যবহৃত ওষুধ সংক্ষেপে দেয়া হল। যথা- ১. একোনাইট ২. বেলেডোনা ৩. ব্রায়োনিয়া ৪. আর্নিকা মন্টানা ৫. আর্সেনিক ৬. বেঞ্জোয়িক এসিড ৭. বার্বেরিস ৮. ক্যাক্টাস ৯. কার্বলিক এসিড ১০. কালোফাইলাম ১১. ক্যামোমিলা ১২. চায়না ১৩. ডিজিটেলিস ১৪. কালমিয়া ১৫. কলসিকাম ১৬. ফেরাম ফস ১৭. ক্যালি কার্ব ১৮. ল্যাক-ক্যানাইনাম ১৯. লিডাম ২০. লাইকোপাস ভার্জিনিকা ২১. পালসেটিলা ২২. রাসটক্স ২৩. মার্কসল ২৪. স্পজিয়া ২৫. সালফার উল্লেখযোগ্য। তারপরও চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থেকে ওষুধ সেবন করা উচিত। অন্যথায় হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
==========================================

ডাঃ এস.জামান পলাশ
জামান হোমিও হল
01711-943435
ওয়েব সাইট –www.zamanhomeo.com
ব্লগ–https://zamanhomeo.com/blog
ফেসবুক–https://www.facebook.com/ZamanHomeoHall

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *