বিষণ্ণতার কারণ ও প্রতিকার

1456656_234777613349799_226892538_n
যদি কেউ একের পর এক খারাপ অবস্থার বা মানসিক চাপের মধ্যে দিয়ে যেতে থাকে তবে তার মধ্যে এক বিষাদগ্রস্ত মানসিক অবস্থার সৃস্টি হতে পারে। তখন সে ভাবে তার আর এই খারাপ অবস্থার মধ্য থেকে বেরোনোর উপায় নেই, হতাশ হয়ে যায়, সব আত্মবিশ্বাসও হারিয়ে ফেলে। এই অবস্থাকে বিষন্নতা বলা হয়। সুতরাং একে বলা যেতে পারে বার বার আঘাতের জন্য এক অসহায় অবস্থা।
এটি এক ধরনের মনের রোগ যা আমাদের চিন্তা ও কাজের শক্তিকে এক মুহূর্তে নষ্ট করে দেয়। বিষণ্ণতায় আক্রান্ত ব্যক্তিটির কোন কিছুই এই সময় ভালো লাগেনা। এমনকি যেই কাজ করতে সবসময় সে আনন্দ পেয়ে এসেছে সেই কাজটির উপর থেকে তার মন উঠে যায়। ভালো লাগে না কাছের মানুষটির সান্নিধ্যও। যার বিষণ্ণতা হয় একমাত্র সেই বোঝে তার নির্মম কষ্ট। এই রোগটি মানুষের জীবনীশক্তি নষ্ট করে দেয়। এ রোগ হলে মানুষ বাঁচার ইচ্ছা পর্যন্ত হারিয়ে ফেলে।
কেন হয় এই বিষন্নতা
বংশগত কারণ, জৈবিক কারণ, সামাজিক কারণ প্রভৃতি কারণে বিষণ্ণতা রোগের সূচনা ঘটতে পারে। বড় বড় রোগব্যাধির কারণেও বিষণ্ণতা হতে পারে। এছাড়া জীবনের ও পারিপার্শিক নানা কারনে মানসিক চাপের জন্য এই বিষন্নতা ভাব আসতে পারে। কেউ কেউ মনে করেন জীবনের নানা ঘাত- প্রতিঘাত ও মানসিক চাপের জন্যই বিষন্নতা হয়।
এটা প্রায়ই দেখা যায় বিশেষ কোনো ক্ষতি হলে বা বিশেষ কিছু হারালে বিষন্নতা আরম্ভ হয়। যেমন নিকট কোনো আত্মীয় স্বজন হারালে বা মৃত্যু হলে, হঠাৎ বেশী টাকার কোনো লোকসান হলে বা চাকরি হারালে বা অবসর নিলে, বিবাহ বিচ্ছেদ বা ভালবাসায় বিচ্ছেদ হলে, এমনকি পরীক্ষায় অসফল হলে, ইত্যাদি। কোন কারনে মন বিষণ্ণ হবে তা অনেকটা নির্ভর করে বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন কারনের উপর বিশেষ গুরুত্ত দেওয়ার জন্য।
নারীরা বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হন বেশি, তাদের বিষণ্ণ হওয়ার আশঙ্কা পুরুষদের চেয়ে ৩ গুণ অধিক।
বিষণ্ণতার ফলাফল1385880_165422110324748_376596878_n
বিষণ্ণতার কারণে ব্যক্তিগত জীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবনও এলোমেলো হয়ে পড়তে পারে। বিষণ্ণতায় আক্রান্ত ব্যক্তি প্রায় অলস প্রকৃতির হয়ে যান। তার দ্বারা তখন কোনো দায়িত্ব পালন করা কঠিন ব্যবহার হয়ে দাঁড়ায়।
বিষণ্ণতার কারণে ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়ায় ক্ষতিসাধিত হয়। রেজাল্ট খারাপ হয়। মেধাবী ছাত্রছাত্রীও বিষণ্ণতার কারণে লেখাপড়ায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারে। স্কুল কলেজ তাদের কাছে তখন বোঝার মতো মনে হতে পারে। বিষণ্ণতায় আক্রান্ত স্ত্রী তার স্বামীর প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারে। ফলে দাম্পত্য জীবনে দেখা দিতে পারে অবনিবনা।
কাদের হয় বিষণ্ণতা
শুধু যে তরুণতরুণীদের মধ্যেই এই বিষণ্ণতা দেখা যায় তা কিন্তু নয়। জীবনের নানা চড়াই-উতরাই পেরোতে গিয়ে কোনো সময় দুঃখের অনুভূতি অনুভব করা স্বাভাবিক। বার্ধক্য বা যাদের বয়স ৬৫ বছর বা তার উপরে তাদের ক্ষেত্রে দুঃখের অনুভূতি অনেকটা উপসর্গ ও লক্ষণ হিসেবে দেখা দিতে পারে।
বার্ধক্যজনিত কারণে বিষণ্নতা হওয়া অনেক সাধারণ ব্যাপার। বিষণ্ণতার কারণে বয়স্ক ব্যক্তিদের স্মৃতিশক্তির অভাব দেখা দিতে পারে। রোগ-বালাই, ব্যর্থতা, অসফলতা, বাধা-বিঘ্নতা, সম্পর্কের অবনতি, ডিভোর্স, বিচ্ছেদ, ভুল বোঝাবুঝি প্রভৃতি বিষয় বিষণ্ণতার জন্য দেখা দিতে পারে।
বিষণ্ণতায় কি হয়
বিষণ্ণতার রয়েছে অনেক অনেক উপসর্গ বা লক্ষণ। আবার কারো কারো ক্ষেত্রে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য লক্ষণ নাও থাকতে পারে। তখন তাদের ক্ষেত্রে রোগ নির্ণয় কিছুটা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিষণ্ণতার কিছু উপসর্গ বা লক্ষণ দেখা যায়।
• কোনো কারণ ছাড়াই অতিরিক্ত ক্লান্তি লাগা।image_20992.air pollution5
• খাওয়ার রুচি কমে যাওয়া।
• ওজন কমে যাওয়া।
• অস্থির অনুভব করা।
• কোনোভাবে বিশ্রাম করতে না পারা।
• অত্যধিক দুশ্চিন্তা করা।
• লোকজনকে এড়িয়ে চলা।
• অল্পতেই উত্তেজিত বা বিরক্ত হয়ে পড়া।
• ঘুমের সমস্যা।
• আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলা।
• নিজেকে অন্যের বোঝা মনে করা।
• মনোসংযোগের অসুবিধা।
• আতঙ্কিত বোধ করা।
• সুইসাইড বা আত্মহননের চিন্তা করা।
বিষন্নতায় কী করা উচিত
চিকিৎসকের সাহায্যে, ওষুধ সেবনে, পরিবার ও বন্ধুদের সহায়তায় আর সাইকোথেরাপির মাধ্যমে বিষন্নতা দূর করা যায়। দৈনন্দিন জীবনে কয়েকটি বিষয় মেনে চললে বিষণ্ন ব্যক্তি ফিরে পেতে পারে স্বাভাবিক জীবন।
* যদি বিষন্নতার লক্ষণ নিজের মধ্যে দেখেন, তাহলে নির্ভরযোগ্য বন্ধু, স্বজনকে বিষয়টি জানান। যদি অন্য কেউ আপনার মধ্যে বিষন্নতার লক্ষণ খুঁজে পায়, তবে অযথা তার সাথে রাগারাগি করবেন না বরং তার পর্যবেক্ষণকে গুরুত্বের সঙ্গে নিন এবং প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
* নিজের কাজটিকে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে ফেলুন, কোন অংশটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা নির্ণয় করুন এবং গুরুত্বের মাত্রা অনুযায়ী জরুরি কাজটি আগে করে ফেলুন।
* নিজের কাছে খুব বেশি কিছু আশা করবেন না,নিজের কাছে খুব বেশি আশা করলে আশাভঙ্গের বেদনায় আরও বেশি বিষাদগ্রস্ত হবেন। মনে রাখবেন আস্তে আস্তে আপনি সবই করতে পারবেন। নিজেকে সময় দিন।
* আত্বীয়স্বজন, বন্ধু আর সহকর্মীদের সঙ্গে সময় কাটান।
* নতুন বন্ধু তৈরি করুন, একা একা সময় কাটাবেন না।
* যেসব কাজ করতে আপনার ভালো লাগে, যাতে আপনি আনন্দ পান সেগুলোই করুন। জোর করে ইচ্ছার বাইরে কোন কাজে নিজেকে নিয়োগ করবেন না।
* প্রতিদিন হালকা ব্যায়াম করুন। ফুটবল, টেনিস বা ক্রিকেটের মতো খেলায় নিয়মিত অংশ নিতে পারেন।
* সামাজিক বা সাংস্কৃতিক যেকোনো কর্মকাণ্ডে নিজেকে ব্যস্ত রাখুন।
বিষন্নতায় কী করা উচিত না
* বিষন্ন অবস্থায় জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কোনো সিদ্ধান্ত-যেমন বিয়ে করা বা না করা, বিবাহবিচ্ছেদ ঘটানো, নতুন চাকরি নেওয়া বা চাকরি ছেড়ে দেওয়া, জমি বা বাড়ি বিক্রি করা ইত্যাদি কাজ থেকে বিরত থাকুন।
* তাড়াহুড়া করে নিজের বিষন্নতাকে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবেন না, সময় নিয়ে বিষন্নতা দূর করুন। নিজেকে দায়ী করবেন না। মনে রাখবেন বিষন্নতা দূর করা কঠিন বিষয় নয়, ধৈর্য ধরে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলুন।
* নিজের ভেতরকার নেতিবাচক চিন্তাগুলোকে প্রশ্রয় দেবেন না, এগুলো বিষন্নতার অংশ-এগুলো বিষন্নতার সঙ্গে সঙ্গে দূর হয়ে যাবে।
* মৃতুচিন্তা আর আত্মহত্যার প্রবণতা থাকলে চেষ্টা করুন সব সময় স্বজন ও বন্ধুদের সঙ্গে থাকতে। মৃতুর কারণ ঘটাতে পারে এমন বস্তু (ছুরি, বঁটি, ওষুধ, দড়ি, ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহন ইত্যাদি) থেকে দূরে থাকুন।
* চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলুন। নিজে নিজে ওষুধের মাত্রা পরিবর্তন করবেন না, নতুন ওষুধ যোগ করবেন না, ওষুধ বন্ধ করে দেবেন না। হঠাৎ করে বিষন্নতারোধী ওষুধ বন্ধ করে দেওয়ার ফল মারাত্মক। চিকিৎসকের নির্দেশমতো ওষুধ বন্ধ করতে পারেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *