ভালোবাসার রসায়ন * কী কারণে একজন পুরুষ বা নারী বিশেষ কারো প্রতি আকর্ষণ বোধ করে ?

1
ভালোবাসার রসায়ন
কী কারণে একজন পুরুষ বা নারী বিশেষ কারো প্রতি আকর্ষণ বোধ করে? এমন কিছু কি আছে? নাকি এই আকর্ষণ শুধুই প্রাকৃতিক! লিখেছেন ডা. মুজাহিদ আকাশ
চাইলেই কি কাউকে নিজের প্রেমে ফেলা যায়? হ্যাঁ, যায়। যদি জানেন যাকে প্রেমে ফেলতে চাচ্ছেন সে কী চায়, কী করলে তার ভেতরে ভালোবাসার বিশেষ সেই রসায়ন জন্ম নেবে আপনাকে ঘিরে!
শুধুই কি প্রাকৃতিক আকর্ষণ নাকি আছে বিশেষ কিছু! এটা খুঁজতে রীতিমতো গবেষণা হয়েছে। ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর প্রফেসর মার্থা ম্যাকক্লিনটক এই গবেষকদের একজন। কাজ করছেন ৭০-এর দশক থেকে। তিনি গন্ধ ও আচরণ বিশেষজ্ঞ। এই গন্ধ পারফিউম বা ওই রকম কিছু নয়। প্রত্যেক মানুষের আছে নিজস্ব কিছু গন্ধ, আছে নিজস্ব কিছু আচরণ। মার্থা কাজ করেন এগুলো নিয়েই। তাঁর গবেষণায় তিনি দেখেন, মাসিকের সময় মেয়েদের ত্বকে একটি বিশেষ ধরনের গন্ধের উদ্ভব হয়, যা তাঁকে প্রজনন কর্মকাণ্ডে আগ্রহী করে তোলে। কারো প্রতি বিশেষ নজর বা ভালোবাসার আকর্ষণ তৈরি করতেও এর ভূমিকা আছে।
তাঁর গবেষণায় আরেকটি মজার তথ্যও বেড়িয়ে এসেছে। এটি ন্যাচার জেনেটিক্সের চলতি সংখ্যায় প্রকাশ হয়েছে। তিনি দেখেন, প্রাপ্তবয়স্ক মেয়েরা পুরুষদের শরীরে এমন গন্ধ পছন্দ করেন, যেটা তাঁর পিতার শারীরিক গন্ধের কাছাকাছি। সিগমুন্ড ফ্রয়েডের তত্ত্বও এ ধারণা সমর্থন করে। গবেষণায় তিনি পুরুষদের শরীরের গন্ধযুক্ত (পারফিউম, বডিস্প্রে বা এ জাতীয় কিছু ব্যবহার করা হয়নি) পোশাক ব্যবহার করেছিলেন। নারীরা জানত না, এগুলো পুরুষদের শরীরের গন্ধযুক্ত। তিনি দেখেছেন, একেকজন নারী একেক ধরনের গন্ধে আকৃষ্ট হয়েছেন। এর মধ্যে পুরুষের গায়ের গন্ধযুক্ত পোশাকের গন্ধের প্রতি বেশি নারী আকৃষ্ট হয়েছেন। উপসংহারে তিনি বলেছেন, গায়ের গন্ধে এমন কিছু আছে, যা বিশেষ কাউকে কাছে টানে।
কী আছে গায়ের গন্ধে? সেটা নিয়ে আবার কাজ করেছেন ড. ডেভিড বারলিনার। তিনি ফেরিন ফার্মাসিউটিক্যালসের সিইও। আগে কাজ করেছেন উটাহ ইউনিভার্সিটিতে এ বিষয়ে। তিনি গবেষণায় দেখেছেন, একজন পুরুষ বা নারী যখন পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ বোধ করেন, তখন তাঁদের ত্বকে বিশেষ ধরনের কেমিক্যালের নিঃসরণ বেড়ে যায়। ক্যামারাডেরি নামের এই কেমিক্যালটির নিঃসরণ কেন বাড়ে বা কিভাবে বাড়ে, তার ব্যাখ্যা বেশ জটিল। কিন্তু বাড়ে। তিনি দেখেছেন, নারী-পুরুষ একসঙ্গে কাজ করছে, পড়াশোনা করছে, খেলা করছে, গল্প করছে_ত্বকে কেমিক্যালটির লেভেল বাড়ছে না। কিন্তু যখনই কারো প্রতি বিশেষ আকর্ষণ তৈরি হচ্ছে, জন্ম নিচ্ছে প্রেমের সম্পর্ক, ভাব বিনিময় হচ্ছে; তখনই বেড়ে যাচ্ছে ক্যামারাডেরির মাত্রা।2
তাহলে কি এই কেমিক্যালটি ব্যবহার করলে বা কারো পোশাকে প্রয়োগ করলে তার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হওয়া সম্ভব? ড. ডেভিডের দৃষ্টিতে তা সম্ভব নয়। কারণ কেমিক্যাল তো আপনাতেই নিঃসরণ হচ্ছে না, এটি নিঃসরণ বাড়াতে সিগন্যাল দিচ্ছে ব্রেন এই সিগন্যাল বাইরে থেকে তৈরি করার পদ্ধতি এখনো জানা যায়নি।
বিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে ব্রেনেই ঘটে সব। ব্রেনের রসায়নের জন্যই কারো জন্য তৈরি হয় পাগলপ্রায় ভালোবাসা। ব্রেনে কী ঘটে? প্রেমে পড়লে ব্রেনে কী ঘটে তা নিয়ে কাজ করছেন নিউ ইয়র্কের রাটজার্স ইউনিভার্সিটির বিশেষজ্ঞ হেলেন ফিশার। প্রেমের জৈবরাসায়নিক পথ বা বায়োকেমিক্যাল পাথওয়ে নিয়ে তাঁর কাজ। তাঁর মতে, মেয়েরা যখনই কারো প্রতি আকৃষ্ট হয়, অবচেতনভাবেই সে ওই পুরুষকে নিয়ে যৌনচিন্তা করে। তার চিন্তার বেশির ভাগ অংশজুড়েই থাকে ওই পুরুষটি তার সন্তানের পিতা হওয়ার মতো যোগ্যতাসম্পন্ন কি না এই বিষয়টি। যদি তার মনে হয়, ওই পুরুষ তার সন্তানের পিতা হওয়ার মতো যোগ্য, তবে সে প্রেমে পড়ার বিষয়টি নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবে। তবে সব নারীই যে এমনটি ভাবেন তা নয়, বেশির ভাগ নারী ভাবেন_সেটাই ফিশার তাঁর গবেষণায় দেখেছেন।images
ফিশারের গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো, গভীরভাবে প্রেমে পড়লে একজন মানুষের মস্তিষ্কে কী ধরনের পরিবর্তন হয় সেটা দেখা। তিনি দেখেছেন, যেসব নর-নারী অন্তত কয়েক মাস ধরে প্রেমের সম্পর্ক তৈরি করেছেন, তাঁদের মস্তিষ্কের ভেন্ট্রাল টেগমেন্টাল এলাকা ও কডেট নিউক্লিয়াসে কিছু পরিবর্তন হয়েছে। এমআরআই করে দেখা গেছে, মস্তিষ্কের ওই অংশ অন্য অংশের তুলনায় কিছুটা আলোক উদ্দীপ্ত। প্রেমকে কডেট নিউক্লিয়াস আলোক উদ্দীপ্ত হওয়ার কারণ বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। এ নিউক্লিয়াসে প্রচুর পরিমাণে ডোপামিন নামের নিউরোট্রান্সমিটার থাকে। এগুলোর মাধ্যমে অনুভূতির আদান-প্রদান হয়। যথাযথ মাত্রার ডোপামিনে এক ধরনের শক্তি তৈরি হয়। এই শক্তির কারণে প্রেমে পড়া মানুষটি তখন কারো প্রতি বিশেষ মনোযোগ, কারো প্রতি বেশি দুর্বল বোধ বা কাউকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কাজটি করে। ফিশারের মতে, এ কারণে মানুষ যখন প্রথম প্রেমে পড়ে কিংবা গভীরভাবে প্রেমে পড়ে, তখন রাতের পর রাত জেগে থাকতে পারে, অন্য সব কিছুকে বাদ দিয়ে প্রেমের জন্য জীবন বাজি রাখতে পারে, সব কিছুকে গুরুত্বহীন মনে করে শুধু প্রেমের মানুষটির জন্য সামান্য কাজকেও ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। এ কারণে প্রেমে পড়া মানুষটির আচরণ স্বাভাবিক মানুষের কাছে অস্বাভাবিক লাগে।
তবে ভালোবাসার কেমিক্যাল হিসেবে কেবল ডোপামিন নয়, আছে আরো কিছু। সেগুলো নিয়ে কাজ করছেন ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের গবেষক লরেন স্ল্যাটার। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের চলতি ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় তিনি জানিয়েছেন, যদি কেউ কাউকে ভালোবাসে এবং কাঙ্ক্ষিত লোকটির কাছ থেকেও সাড়া পায়, তবে প্রেমে পড়া মানুষটির মধ্যে শারীরিক ও মানসিক শক্তি বেড়ে যায়। এর কারণ তার শরীরে অ্যাডরেনালিন নামের হরমোনের নিঃসরণ বেড়ে যাওয়া। যাঁরা প্রেমে পড়েছেন, তাঁরা জানেন সে সময় হার্টবিট বেড়ে যায়, প্রেমের প্রস্তাব দিতে ভয়ে গা ও হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে, সাড়া পেলে ভীষণ সুন্দর মনে হয় সব কিছু, অসম্ভবকে সম্ভব করার শক্তি জাগে মনে_এর সবই অ্যাডরেনালিনের প্রভাব।
চিকিৎসকরা দেখেছেন, অ্যাডরেনালিনের প্রভাবে এ সময় রক্তচাপও বাড়ে। রক্তচাপ বাড়ার বিষয়টি উল্লেখ করে স্ল্যাটার বলেছেন, গভীরভাবে কারো প্রেমে দীর্ঘদিন পড়ে থাকা কিংবা প্রেমে পাগল হয়ে যাওয়ার অবস্থাটি স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নাও হতে পারে।
স্ল্যাটার তাঁর গবেষণায় এটাও দেখেছেন যে যাঁরা পাগলের মতো প্রেমে পড়েছেন, তাঁদের ব্রেনের পরিবর্তন একজন অবসেসিভ কমপালসিভ রোগীর ব্রেনের পরিবর্তনের কাছাকাছি। তাঁর মতে, এই মিলের কারণ উভয় ক্ষেত্রে শরীরে সেরোটনিন লেভেল বেড়ে যাওয়া। কাউকে নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করলেই সেরোটনিন বেড়ে যায়। কিন্তু প্রেমে পড়ার পরিণতি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হয় ভালো, অবসেশনের পরিণতি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হয় খারাপ।

প্রেমে পড়লে কী কী হয়, হতে পারে_এ নিয়ে গবেষণা হয়েছে বিস্তর; কিন্তু কাউকে প্রেমে ফেলার উপায় যে জানা যায়নি! কারণ যে প্রেমে পড়ে, সেই তো জানে না কেন বিশেষ কাউকে দেখলেই কেবল তার এমন ধুকপুক লাগে!

**********************************************************
ডাঃ এস.জামান পলাশ
জামান হোমিও হল
01711-943435
ওয়েব সাইট –www.zamanhomeo.com
ব্লগ–https://zamanhomeo.com/blog
ফেসবুক–https://www.facebook.com/ZamanHomeoHall

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *