মন খারাপের অস্বাভাবিক বহিঃপ্রকাশ বিষণ্নতা

ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতা একটি মানসিক সমস্যা। যদিও এ সমস্যার প্রধান লক্ষণ মন খারাপ থাকা, তবে মন খারাপ থাকা মানেই বিষণ্নতা নয়। এটি মন খারাপের চেয়ে কিছু বেশি। মন খারাপ সাধারণ একটি মৌলিক আবেগ, আর বিষণ্নতা হচ্ছে সেই আবেগের অস্বাভাবিক বহিঃপ্রকাশ। মন খারাপের জন্য বেশির ভাগ সময় কারণ খুঁজে পাওয়া যায়, কিন্তু বিষণ্নতার কারণ সবসময় পাওয়া নাও যেতে পারে। মন খারাপ ক্ষণস্থায়ী আর বিষণ্নতা দীর্ঘমেয়াদি। বিষণ্ন হলে কর্মক্ষমতা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে যায়, কিন্তু মন খারাপ হলে কর্মক্ষমতা তেমন প্রভাবিত হয় না। মন খারাপের কোনো চিকিৎসা লাগে না, অন্যদিকে বিষণ্নতার চিকিৎসা প্রয়োজন হয়। অর্থাৎ মন খারাপ কোনো রোগ নয়, কিন্তু বিষণ্নতা একটি মানসিক রোগ। বিষণ্নতার কারণে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, শিক্ষাগত, পেশাগত ও সামাজিক জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং স্বাভাবিক কর্মতত্পরতা ব্যাহত হয়।

বিষণ্নতা কেন হয়

বিষণ্নতায় আক্রান্ত হওয়ার পেছনে নানা কারণ থাকে, নির্দিষ্ট কোনো কারণ এক্ষেত্রে দায়ী নয়। দেখা যায় হয়তো একজন যে কারণে বিষণ্নতায় ভুগছেন, সেই একই কারণে আরেকজনের বিষণ্নতা হলো না। তাই সরাসরি কারণ না বলে বিষণ্নতার ঝুঁকি হিসেবে যেসব বিষয়কে চিহ্নিত করা হয় সেগুলো হচ্ছে:

–               বংশগতি বা জেনেটিক কারণ

–               বিষণ্নতার পারিবারিক ইতিহাস

–               নারীদের মধ্যে বিষণ্নতার হার পুরুষদের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ

–               আগে কখনো বিষণ্নতায় আক্রান্ত হওয়া

–               দরিদ্র, গৃহহীন, ঋণগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিষণ্নতার ঝুঁকি বেশি

–               শৈশবে বাবা-মা হারানো, বাবা-মায়ের মধ্যে বিচ্ছেদ, শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতন পরবর্তী জীবনের বিষণ্নতার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়

–               দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক রোগে (যেমন ব্রেন স্ট্রোক, হূদরোগ, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার) আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে বিষণ্নতার ঝুঁকি অন্যদের চেয়ে বেশি

–               মাদকাসক্তি বিষণ্নতার অন্যতম কারণ

–               প্রসবোত্তর, মাসিক চলাকালীন ও মেনোপজের পর বিষণ্নতা হওয়ার ঝুঁকি বেশি

–               পারিবারিক সহিংসতা, শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতন বিষণ্নতার অন্যতম ঝুঁকি

–               এছাড়া জলবায়ুর পরিবর্তন, দুর্যোগ, অপরিকল্পিত নগরায়ণ আর মানুষের জীবনাচারের পরিবর্তনও বিষণ্নতার অন্যতম ঝুঁকি হিসেবে বিবেচিত

–               বিগত দুই বছরে কভিড অতিমারীকালে বিশ্বজুড়ে বিষণ্নতার হার বৃদ্ধি পেয়েছে

–               মানসিক চাপ নিয়ে কাজ করতে হয় এমন পেশাজীবীদের মধ্যে বিষণ্নতার হার বেশি

কাদের হয়?

যে কারো বিষণ্নতা হতে পারে। যেকোনো বয়সেই হতে পারে। তবে ১৮ থেকে ৪৪ বছর বয়সীরা বিষণ্নতার জন্য বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন বলে গবেষণায় দেখা গেছে। বাংলাদেশে ২০১৮-১৯ সালের জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য জরিপ অনুযায়ী প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মাঝে প্রায় ৭ শতাংশের বিষণ্নতা রয়েছে।

বিষণ্নতার সাধারণ লক্ষণ

–               কমপক্ষে দুই সপ্তাহজুড়ে দিনের বেশির ভাগ সময় মন খারাপ থাকা

–               আগে যেসব কাজ বা বিনোদন ভালো লাগত এখন সেগুলো ভালো না লাগা

–               খিটখিটে মেজাজ, হঠাৎ রেগে যাওয়া

–               মনোযোগ কমে যাওয়া, ক্লান্তি বোধ করা, ভুলে যাওয়া

–               ঘুমের সমস্যা, যেমন খুব ভোরে ঘুম ভেঙে যাওয়া বা কখনো বেশি ঘুম

–               রুচির সমস্যা, যেমন খেতে ইচ্ছে না করা, খিদে না থাকা বা বেশি খাওয়া

–               ওজন কমে যাওয়া বা বেড়ে যাওয়া

–               যৌনস্পৃহা কমে যাওয়া

–               নিজেকে অপরাধী, ছোট ভাবা

–               মৃত্যুচিন্তা করা, আত্মহত্যার চেষ্টা করা

–               শারীরিক লক্ষণ যেমন মাথাব্যথা, মাথায় অস্বস্তি, মাথা-শরীর-হাত-পা জ্বালা করা, গলার কাছে কিছু আটকে থাকা, শরীর ব্যথা, গিঁটে গিঁটে ব্যথা, বুক জ্বালা, বুকে ব্যথা

–               একা একা থাকা, নিজেকে গুটিয়ে রাখা

তবে বিষণ্নতা নির্ণয়ের জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ প্রয়োজন।

লক্ষণ দেখা দিলে করণীয়

কারো মধ্যে বিষণ্নতার লক্ষণ দেখা দিলে সেটাকে মোটেই এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। সবার আগে অবশ্যই মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ বা নিকটস্থ চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।

আরো যা যা করা যেতে পারে

–               নিজের মধ্যে বিষণ্নতার উপস্থিতি রয়েছে মনে হলে নির্ভরযোগ্য বন্ধু বা স্বজনকে বিষয়টি জানাতে হবে

–               যেসব কাজ করতে ভালো লাগে বা লাগত, যাতে আনন্দ পান বা পেতেন সেগুলো এখন করতে ভালো না লাগলেও চেষ্টা করে দেখতে হবে

–               নিয়মিত নিজের যত্ন নিন, পরিষ্কার পোশাক পরুন

–               হালকা ব্যায়াম করুন, খেলাধুলায় অংশ নিন।  সামাজিক  অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে চেষ্টা করুন

–               ভালো বোধ করার জন্য নিজেকে সময় দিন, চিকিৎসকের ওপর আস্থা রাখুন। বিষণ্নতার চিকিৎসায় ফল পেতে অনেকটা সময় লাগে

–               বিষণ্ন অবস্থায় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া থেকে বিরত থাকুন

–               মৃত্যুচিন্তা আর আত্মহত্যার প্রবণতা থাকলে একা থাকবেন না। স্বজন, বন্ধু আর সহকর্মীদের সঙ্গে সময় কাটান এবং চিকিৎসককে জানান

–               চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ বা কাউন্সেলিং বন্ধ করবেন না। মনে রাখবেন বিষণ্নতার চিকিৎসায় ওষুধ ও কাউন্সেলিং—দুই-ই জরুরি। ওষুধকে ভয় পাবেন না

–               কখনোই চিকিৎসক প্রদত্ত ওষুধ সেবনকে নিরুৎসাহিত করবেন না।