ডাঃ এস.জামান পলাশ
>>>>>>>>>>>
রোজা একটি কষ্টকর ফরজ ইবাদত। তবে তা সুস্থ মানুষের জন্য, অসুস্থ বা ভ্রমণকারীর জন্য রোজা
নয়। রমযান মাসে রোজা রাখা স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য নয়। রোজা রাখার উদ্দেশ্য আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলে দিয়েছেন আর তা হলো তাকওয়া বা খোদাভীতি অর্জন করা। আমাদের বর্তমান আলোচনার উদ্দেশ্য হলো রমযান মাসের রোজা স্বাস্থ্যের উপর কি ধরনের প্রভাব ফেলে, যারা বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যায় আক্রান্ত তারা রোযা রাখতে পারবেন কিনা, রোজায় ওষুধ কিভাবে সেবন করতে হবে, রোজায় কি ধরনের খাবার স্বাস্থ্যর জন্য উপযোগী সে ব্যাপারে আলোকপাত করা।
রোজা রাখার কারণে শরীরে কি ধরনের পরিবর্তন হয় :
অনেকের কাছে একটা জিজ্ঞাসা-রোজা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর না উপকারী? রোজার কারণে দেহ ৮ ঘণ্টা বা তার চেয়ে বেশি খাবার ছাড়া থাকে। সাধারণ অবস্থায় লিভারে ও মাংসপেশীতে যে গ্লুকোজ জমা থাকে যা শরীরকে শক্তির যোগান দেয়। রোজায় এগুলো ব্যবহার হয়ে যায়। এরপর শরীরে জমা চর্বি ব্যবহৃত হয়। রোজায় যতটুকু সময় আমরা না খেয়ে থাকি এ সময় শরীরের প্রোটিন শক্তির জন্য ব্যবহৃত হয় না। যার কারণে রোজায় শরীরে চর্বির পরিমাণ কমে যায়। কিন্তু শরীরের গঠন ঠিক থাকে।
রমযানে শারীরিক সমস্যা হয় মূলত :
• অসম খাওয়া দাওয়া।
• অতিরিক্ত খাওয়া দাওয়া।
• অপর্যাপ্ত ঘুম।
রমযান ও হৃদরোগ :
• হার্টের রোগীরা কি রোজা রাখবেন?
• যাদের এনজিওপ্লাস্টি করে হার্টে স্টেন্ট/রিং লাগানো আছে তারা কি রোজা রাখবেন?
• যাদের হার্টের বাইপাস অপারেশন হয়েছে তারা কি রোজা রাখবেন?
• হার্ট ফেইলুরের রোগীরা কি রোজা রাখবেন?
যাদের ঘন ঘন বুকের ব্যথা হয় এবং বার বার ওষুধ খাওয়া লাগে তাদের রোজা না রাখাই ভালো। যাদের হার্ট ফেইলুর আছে, শ্বাসকষ্ট হয় এবং অল্প ব্যবধানে ওষুধ সেবন করতে হয় তাদেরও রোজা রাখা জরুরি নয়। কিন্তু যাদের হার্টের সমস্যা স্থিতিশীল তারা চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে সতর্কতার সাথে রোজা রাখতে পারবেন। হার্টের রোগীরা রোজা রাখার মাধ্যমে ধর্মীয় দায়িত্বের পাশাপাশি বিভিন্নভাবে উপকৃত হন।
• যে সব হার্টের রোগীদের একই সাথে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও উচ্চ কোলেস্টেরল থাকে রোজার মাসে তারা কম চিনি, কম লবণ ও কম চর্বিজাতীয় খাবারের মাধ্যমে তাদের রোগসমূহ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।
• বেশি ওজন ও ওবেসিটি হার্টের সমস্যা বাড়ায়। রোজা রেখে ওজন কমানের মাধ্যমে আমরা হার্টের সমস্যা কমাতে পারি।
• যারা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছেন কিন্তু ধূমপান ছাড়তে পারছেন না তারা রোজার মাধ্যমে ধূমপান পরিত্যাগের উদ্যোগ নিতে পারেন।
• হার্টের রোগীরা হতাশায় ভোগেন, রোজায় যে আত্মিক উন্নতি হয় তার মাধ্যমে তারা হতাশা থেকে মুক্ত হতে পারেন।
হার্টের রোগীদের জন্য কয়েকটি পরামর্শ :
হার্টের রোগী যারা রোজা রাখতে চান তারা আপনার ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করুন এবং রোজার শুরুতেই ডাক্তারের কাছে চেক-আপ করুন।
• প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ে ওষুধ সেবন করুন।
• রোজার বিধি নিষেধ পালন করে ধূমপানের অভ্যাস ভঙ্গ করুন।
• রোজার মাসে হালকা ব্যায়াম করতে পারেন যেমন ইফতারির আগে সামান্য হাটতে পারেন।
রমযান ও ডায়াবেটিস :
চিকিৎসার প্রয়োজনেও রোজা রাখা যেতে পারে। রোজার মাধ্যমে ওজন নিয়ন্ত্রণ করা যায়, পাকস্থলী ও খাদ্যনালীকে বিশ্রাম দেয়া যায় ও রক্তের চর্বির পরিমাণ কমানো যায়। রোজার কারণে রক্তে চিনির পরিমাণ কমে, চর্বির পরিমাণ কমে ও রক্তচাপ কমে। নন-ইনসুলিন ডিপেন্ডেন্ট ডায়াবেটিস রোগীরা সতর্কতার সাথে রোজা রাখতে পারেন কিন্তু যারা ইনসুলিন ডিপেন্ডেন্ট ডায়াবেটিস রোগী, তাদের রোজা রাখা ঝুঁকিপূর্ণ। টাইপ-২ ডায়াবেটিস (খাবারের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ) এর রোগীরা সতর্কতার সাথে রোজা রাখতে পারেন।
রোজায় ডায়াবেটিস রোগীদের কি সমস্যা হতে পারে :
• হাইপোগ্লাইসিমিয়া (রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ কমে যাওয়া)।
• হাইপারগ্লাইসিমিয়া (রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া)।
• ডায়াবেটিস কিটোএসিডোসিস।
• পানিশূন্যতা এবং থ্রোম্বোসিস।
ইনসুলিন দ্বারা :
ঝুঁকিপূর্ণ তবে সতর্কতার সাথে ব্যবহার করা যায়। রমযানে যেসব টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীরা ইনসুলিন নেন তারা ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করবেন। ইনসুলিন নেয়ার ক্ষেত্রে সকালের ডোজ ইফতারির সময় নেবেন এবং রাতের ডোজ সেহরীর সময় নেবেন।
ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য কয়েকটি পরামর্শ :
• চিনি জাতীয় খাবার পারতপক্ষে খাবেন না।
• শর্করা জাতীয় খাবার- যেমন ঃ ভাত, চা, নানরুটি খেতে পারেন।
• ফলমূল, শাক-সবজি, ডাল, দই খেতে পারেন।
• সেহরীর শেষ সময় সেহরীর খাবার খাবেন।
• প্রচুর পরিমাণে চিনি ছাড়া পানীয় খাবেন।
• তৈলাক্ত ভাজা খাবার যেমন- পরাটা, লুচি, সমুচা, সিংগাড়া, কাবাব খাবেন না।
রোজা ও গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা : রমযান মাসে পাকস্থলীসহ পরিপাকতন্ত্র বিশ্রাম পায়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যাদের পেপটিক আলসার, পাকস্থলীর প্রদাহজনিত রোগ, ক্ষুধামন্দা ইত্যাদি আছে তারা রোজার মাধ্যমে উপকৃত হন। রোজা রাখার কারণে পাকস্থলীতে এসিড কম তৈরি হয়। অতিরিক্ত ভাজা-পোড়া খাবার গ্রহণে অতিরিক্ত এসিড তৈরি হতে পারে যার কারণে বুক জ্বালা-পোড়া হতে পারে।
এজন্য যাদের আগে থেকে গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা আছে তারা একদিকে যেমন ভাজা-পোড়া ও তৈলাক্ত খাবার পরিহার করবেন পাশাপাশি নিয়মিত ওষুধ সেবন করবেন এবং চা-কফি ও ধূমপান করবেন না।
রমযানে অন্যান্য শারীরিক সমস্যা :
মাথা ব্যথা-রোজার সময় বিভিন্ন কারণে মাথাব্যথা হতে পারে। যেমন- পানিস্বল্পতা , ক্ষুধা, কম বিশ্রাম, চা-কফি না খাওয়া। এগুলো সমাধানে প্রচুর পরিমাণে ফলের রস খাওয়া যেতে পারে। প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া দরকার।
কোষ্ঠকাঠিন্য : প্রচুর পরিমাণ পানি, শাক-সবজি খাওয়া দরকার।
শারীরিক অবসাদ : কম পানি পান করার কারণে প্রেসার কমে যেতে পারে। এক্ষেত্রে অতিরিক্ত ঘাম, দুর্বলতা, ক্লান্তি ও শরীর অবসন্ন লাগতে পারে।
মাংসে খিচুনী : খাবারে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও পটাশিয়াম কম থাকলে খিচুনী হতে পারে।
কিডনী পাথর : কম পানি খাওয়ায় পাথর হতে পারে।
রমযান ও খাদ্য খাবার : রমযান মাসের খাবার অন্যান্য মাস থেকে খুব পার্থক্য হওয়া ঠিক না এবং সাধারণ খাবার হওয়া উচিত। খাবার এমন হওয়া উচিত যাতে ওজন বেশি না কমে আবার বেশি না বাড়ে।
ওজন যাদের বেশি তারা এ সময় ওজন কমানোর জন্য কম খাওয়া উচিত। রোজার মাসে বিশেষ করে সেহরীর সময় ধীরে ধীরে হজম হয় (৬-৮ ঘণ্টা) এমন খাবার খাওয়া উচিত। খাবার ভারসাম্যপূর্ণ হওয়া উচিত যার মাঝে ফলমূল ও শাক-সবজি থাকবে, রুটি, ভাত বা আলু থাকবে, দুধ ও দুধজাতীয় খাবার থাকবে, চর্বি ও মিষ্টি জাতীয় খাবার থাকবে এবং সর্বোপরি মাছ, গোশত বা ডিম থাকবে।
ইফতারি : সুন্নাত মোতাবেক খেজুর দিয়েই ইফতার শুরু করা উচিত যা শরীরকে দ্রুত শক্তি দেয়। এছাড়া ফলের রস থাকতে পারে এবং স্বাস্থ্যসম্মত যে কোন স্বাভাবিক খাবার ইফতারিতে খাওয়া যেতে পারে।
কয়েকটি পরামর্শঃ
• ইফতারী ও সেহরীর মাঝের সময় প্রচুর পানি খেতে হবে।
• চিনি জাতীয় খাবারের পরিবর্তে ফলের রস খেতে হবে।
• স্যুপ খাওয়া যেতে পারে।
• ধীরে ধীরে খেতে হবে, দ্রুত নয়।
• সেহরীর সময় চা, কফি ও কোলা জাতীয় পানীয় খাওয়া যাবে না। কেননা এতে ক্যাফেইন থাকে যা প্রেসারের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়।
খাবার যা পরিহার করা উচিত :
• ভাজাপোড়া- যেমন বেগুনী, পিয়াজু, সমুচা।
• অতিরিক্ত মিষ্টি- রসগোল্লা, কালোজাম, জিলাপি।
• অতিরিক্ত তৈলাক্ত- পরাটা, তৈলাক্ত তরকারি, পেস্ট্রি ইত্যাদি।
• সেহরীর সময় অতিরিক্ত খাওয়া।
খাবার যা খাওয়া যেতে পারে :
• জটিল শর্করা জাতীয় খাবার যেমন- ভাত, রুটি, নান, শাক-সবজি, আঁশ জাতীয় তরকারি এবং মাছ-মাংস জাতীয় খাবার।
• হালিম- চিনি, শর্করা, ফাইবার, পটাশিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম থাকে।
• কলা- পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম এবং শর্করা থাকে।
রমযান মাসে ওষুধ সেবন :
রমযানে ওষুধ সেবনের ব্যাপারে চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করা জরুরি। এ ব্যাপারে ইসলামী চিন্তাবিদদের ভেতরে কিছুটা মতভিন্নতা আছে। এই মত পার্থক্য নিরসনের জন্য ১৯৯৭ সালে মরক্কোতে বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ, চিকিৎসক, ফার্মাকোলজিস্ট ও বিভিন্ন পর্যায়ের বিজ্ঞানীরা একটি সেমিনার করেন। “An Islamic view of certain contemporary medical issue” নামক এ সেমিনারে নিম্নলিখিত মতামত পেশ করা হয়-
যে সব ওষুধে রোজা নষ্ট হবে না :
০ চোখ ও কানের ড্রপ।
০ ক্রিম, অয়েনমেন্ট, মেডিকেটেড প্লাস্টার যা চামড়ার উপরে লাগানো হয়।
০ সব ধরনের ইনজেকশন যা দেয়া হয় চামড়ায়, মাংসে, শিরায় (খাবারের উদ্দেশ্য ছাড়া)।
০ অক্সিজেন ও অজ্ঞানকারী গ্যাস।
০ বুকে ব্যথার জন্য জিহবার নীচে নাইট্রোগ্লিসারিন ট্যাবলেট।
০ মাউথওয়াশ, গার্গল, মুখে স্প্রে, শর্ত হচ্ছে তা পাকস্থলীতে যাবে না।
০ নাকের ড্রপ, নাকের স্প্রে, ইনহেলার।
ওষুধ খাবার সময়সূচি :
রমযানে ওষুধ সেবনের সময়সূচি কিছুটা পরিবর্তন করা দরকার হয়।
-যারা দিনে একবার ওষুধ সেবন করেন তারা ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে ইফতারি ও সেহরীর মাঝখানে সুবিধাজনক সময়ে ওষুধ সেবন করতে পারেন।
-যারা দিনে দুইবার বা তার চেয়ে বেশিবার ওষুধ খান তাদেরকে সুবিধামত ইফতারির সময়, রাতে শোবার সময় অথবা সেহরীর সময় ওষুধ মিলিয়ে সেবন করতে হবে। তারপরও যাদের সমস্যা হবে ইসলামের বিধান অনুযায়ী তারা রোজা রাখা থেকে বিরত থাকতে পারেন। বর্তমান বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির Extended Release বিভিন্ন ওষুধ বাজারে আছে যা একবার খেলে সারাদিন কার্যকরী হয়। রমযান মাসে এসব ওষুধ সেবন করে রোজা রাখা যায়।
===================================
★ পোস্ট ভাল লাগলে লাইক ★ শেয়ার করে পেইজে একটিভ থাকুন।
( প্রতি মুহুর্তের চিকিৎসা বিষয়ক খবর গুলো নিয়মিত পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিন ) https://www.facebook.com/ZamanHomeoHall