ডা. হায়দার আলী : এমন কোন রোগের কথা চিন্তা করা যায় না যা হোমিওপ্যাথির থেকে উত্তম চিকিৎসা করা যায় । ডা. স্যামুয়েল হ্যানিম্যান ।
আজ ১০ই এপ্রিল। হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক বিজ্ঞানী হ্যানিম্যানের জন্ম দিন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন ভাষায় আলোচিত হবে তাঁর বহুধা বিস্তৃত কর্মমূখী জীবন এবং হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিভিন্ন দিক, সম্ভাবনা, সমস্যা ও সমাধান নিয়ে। এরই ক্ষুদ্র অংশ এ লেখা। কালের কষ্টি পাথরে যাচাই করা এক অনন্য, অসাধারণ প্রতিভার নাম হ্যানিম্যান। যিনি ১৭৫৫ খ্রি. ১০ই এপ্রিল জার্মানীর স্যাক্সনী রাজ্যের ক্ষুদ্র নগরী মিসেনে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা হলেন পেশায় কুমার; ছিলেন সত্যনিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। তাই পুত্রের প্রতি উপদেশ ছিল সকল বিষয়েই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখবে। পরে যেটি সত্য বলে প্রমাণিত হবে-সেটাই গ্রহণ করবে।
মাত্র ২৪ বৎসর বয়সে এনলার্জেন বিশ্ববিদ্যায় থেকে তখনকার সর্বোচ্চ এলাপ্যাথিক চিকিৎসা শাস্ত্রীয় ডিগ্রী এম.ডি অর্জন করেন হ্যানিম্যান। পরিচিত হন ইউরোপে একজন সর্বজন পরিচিত সার্জন-চিকিৎসক হিসাবে। তিনি ছিলেন বহুভাষাবিদ। ১৪টি ভাষা তিনি জানতেন। মেধাবী ছাত্র হিসাবে ছাত্রজীবনেই স্কুলে শিক্ষকদের নির্দেশে ছাত্রদের গ্রীক এবং হিব্রুভাষা শিক্ষা দিতেন। চিকিৎসা বিদ্যা ছাড়াও তিনি ইংরেজী, ফরাসী, ইটালিয়ান ভাষা থেকে অনুবাদ করেন, ফিজিওলজি, কৃষিবিদ্যা, স্বাস্থ্যবিদ্যা ও রসায়ন শাস্ত্র বিষয়ক কতগুলো বিখ্যাত গ্রন্থ। তাঁর রচিত গ্রন্থের মধ্যে একমাত্র রাসায়ন শাস্ত্রেই ৭২টি গ্রন্থ। এর মধ্যে ফার্মাসিউটিক্যাল লেক্সিকন বইটির সাহায্য নেওয়া হয় আজও জার্মানীতে। আর্সেনিক পয়জনিং সম্পর্কে রচিত বই থেকে ইংল্যান্ডে পড়ানো হয়, অবশ্য বেনামে। দীর্ঘ দিন প্রচলিত চিকিৎসা কার্য করে তাতে আত্মতৃপ্তি না পেয়ে তাহা পরিত্যাগ করেন। পরে তিনি অনুবাদ কার্য করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তখন তাঁর জীবনে দেখা দেয় চরম অর্থ সংকট। এরপরও তিনি অর্থের মোহ ত্যাগ করে প্রচলিত চিকিৎসা ব্যবস্থা থেকে নিজেকে সরিয়ে অনুবাদ কার্যেই নিয়োজিত রাখেন। ১৭৯০ খ্রি. একদিন হ্যানিম্যান উইলিয়াম কালেনের ইংরেজীতে লেখা “এট্রিয়েটিস অব মেটেরিয়া মেডিকা” এর দ্বিতীয় খন্ড অনুবাদকালে উক্ত গ্রন্থের এক অংশে তাঁর দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছিল। উহাতে লেখা ছিল কুইনাইনের উৎস স্বরূপ সিন্কোনা বা চায়নার যে জ্বর নাশক গুন আছে তার কারণ কি ? তার কারণ এই যে, সুস্থ্য শরীরে ম্যালেরিয়া জ্বর সদৃশ্য অবস্থা উৎপাদন করিবার শক্তি আছে। এই সত্যটুকু পরীক্ষা করার জন্য হ্যানিম্যান সুস্থ্য শরীরে চায়না প্রয়োগ করিয়া (ম্যালেরিয়া) কম্পজ্বর সদৃশ্য অবস্থা লক্ষ্য করেছিলেন। তিনি হঠাৎ কোন মন্তব্য না করিয়া ৬ বৎসর যাবৎ অবিরাম পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণা করার পর হাফলেন্ডের জার্নালে “On a new principle for ascertaining the Curative of Properties of drug” শিরনামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। ইহাই হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের জন্মের সূচনা।
সর্বোপরি তিনি হোমিওপ্যাথি নামক আরোগ্যকারী চিকিৎসা পদ্ধতির জনক হিসেবে চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক যুগান্তকারী ধারা প্রবর্তন করেন।
বিজ্ঞানী হ্যানিম্যানের কয়েকটি বিশিষ্ট বৈজ্ঞানিক আবিস্কার হল-
১। পরীক্ষামূলক ও আরোগ্যকারী সদৃশ্য বিধানে প্রাকৃতিক চিকিৎসা পদ্ধতি।
২। সুস্থ্য মানব দেহে ঔষধ পরীক্ষা করে ঔষধের কার্যকারী ক্ষমতা নির্ধারণ।
৩। চিকিৎসা ক্ষেত্রে জীবনী শক্তি তত্ত্বের আবিস্কার
৪। রোগ সংক্রামণ তত্ব ও কলেরার কারণ প্রসঙ্গে জীবানু তত্ত্বের পূর্বাভাস।
৫। মানসিক রোগের চিকিৎসা পদ্ধতি ও নির্যাতন মূলক চিকিৎসার বিরোধিতা।
৬। পথ্য বিজ্ঞানে নির্দিষ্ট নিয়মনীতি, খাদ্যতত্ত্ব ও পথ্যাপথ্যের প্রয়োজনীয়তা।
৭। রসায়ন ও ফার্মেসীতে মূল্যবান আবিস্কার ও পারদকে দ্রবীভূত করা।
৮। চির রোগের মূল কারণ হিসেবে মায়াজম্ তত্ত্বের আবিস্কার।
হ্যানিম্যান ছিলেন একজন অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসক। কিন্তু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ও মানবতাবাদী। ঐ সময়ে তার দেশে শাস্ত্রমতে চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন রোগীর রোগ সম্পূর্ণ আরোগ্য হচ্ছে না। চিকিৎসা গ্রহণের পর কোনো কোনো রোগীর দুর্ভোগ আরো বেড়ে যাচ্ছে। এসব দেখে তিনি মনে মনে খুবই কষ্ট পাচ্ছিলেন আর ভাবছিলেন ওষুধ ও পদ্ধতি দুই-ই কিভাবে উন্নত করা যায়। বিদেশে গিয়ে গ্রহণ করেন এমডি ডিগ্রি। কিন্তু তাতে তার নিজের শিক্ষা বাড়লেও ওষুধ আর পদ্ধতিতে কোনো গুণগত পরিবর্তন ঘটেনি। ফলে চিকিৎসার ফলাফল একই থেকে যায়। এ পর্যায়ে তার এক আত্মোপলব্ধি হয়, ‘আমি এতদিন যত রোগীর চিকিৎসা দিয়েছি, চিকিৎসা না নিলেও তারা এর চেয়ে ভালো থাকতেন।’ এর পরও তিনি ভাবছিলেন কিভাবে মানুষকে সঠিক চিকিৎসাসেবা দেয়া যায়। কিন্তু কোনো উপায় আবিষ্কার করতে না পেরে হতাশাগ্রস্ত চিকিৎসক চিকিৎসা পেশাই ত্যাগ করেন এবং বিজ্ঞানগ্রন্থের অনুবাদকর্মে আত্মনিয়োগ করেন। একই সঙ্গে বহু ভাষায় দক্ষতা অর্জনের চেষ্টা চালান। এভাবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বই অনুবাদ করে অনুবাদক হিসেবে তিনি খ্যাতিমান হয়ে যান। এমনই একদিন ১৭৮৯ সালে তিনি এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডা. উইলিয়াম কালনের ‘এ ট্রিয়েটিস অন মেটেরিয়া মেডিকা’ বইটি ইংরেজি থেকে জার্মান ভাষায় অনুবাদের সময় এক জায়গায় দেখতে পান, ‘সিঙ্কোনা’ বা ‘পেরুভিয়ান বার্ক’ সুস্থ শরীরে প্রয়োগ করলে ম্যালেরিয়ার রোগসদৃশ কম্পজ্বরের লক্ষণাবলি উৎপাদন করে। এ সূত্র ধরেই ১৭৯০ সালে তিনি নিজ শরীরে সিঙ্কোনার ছাল প্রয়োগ করে দেখেন ডা. কালনের কথা সত্য। এরপর এক এক করে তিনি ৯০টি (মতান্তরে ৯৯টি অথবা ১৩০টি) ওষুধের ওপর পরীক্ষা চালান এবং ফলাফল লিপিবদ্ধ করেন। এসব ফলাফল থেকেই ১৭৯৬ সালে তিনি তার চিকিৎসা পদ্ধতির নাম ‘হোমিওপ্যাথি’ ঘোষণা করেন।
ডা. হ্যানিম্যান বিশ্বাস করতেন, চিকিৎসা শুধু পেশা নয় জীবনের মহৎ কর্তব্য। চিকিৎসা শব্দটির সঙ্গে সেবা শব্দটির যোগ আছে। রোগ ও রোগীর সেবা। মানবজাতিকে রোগযন্ত্রণা থেকে আরোগ্যদানের উদ্দেশ্যে যারা নিজেদের নিয়োজিত করেন তারা চিকিৎসক। আর সেবা শব্দটির জন্যই চিকিৎসা একটি মহৎ, পবিত্র ও মানবীয় পেশা। বহু শতাব্দী ধরে এ পেশার উন্নয়ন ও আধুনিকায়নে মহামানবরা প্রাণান্ত পরিশ্রম করেছেন।
আগের দিনে একটি রোগকে জয় করার জন্য বিজ্ঞানীরা ছিলেন নিবেদিত, আবিষ্কারকরা উৎসাহী আর চিকিৎসক জীবনব্যাপী অনুসন্ধানী। কেউ কেউ একাই লড়েছেন বিরুদ্ধ পরিস্থিতির সঙ্গে। যেমন ডা. স্যামুয়েল হ্যানিম্যান। কিন্তু গত অর্ধশতাব্দী ধরে মানুষ মাবিক মূল্যবোধ জলাঞ্জলি দিয়ে প্রতিটি পদক্ষেপে হয়ে গেছে হিসাবি। ফলে তারা মহান পেশাকে নানাভাবে হেয় করছে, অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, হাসপাতাল-ক্লিনিক, দালাল, প্যাথলজিক্যাল ল্যাব, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ওষুধ বিক্রেতা, দেশি-বিদেশি কোম্পানি ইত্যাদি নানা নামে রোগীকে সর্বস্বান্ত করার জন্য দেশে-বিদেশে গড়ে উঠছে অসংখ্য চক্র।
মানুষ যখন অর্শ, ক্যান্সার, ভাইরাস সংক্রমণের মতো কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়, খুব অসহায় হয়ে পড়ে। প্রিয়জন কিংবা নিজেকে বাঁচানোর জন্য দিগ্বিদিক ছুটতে থাকে, সবচেয়ে নির্ভর ও বিশ্বাসযোগ্য চিকিৎসকের খোঁজে। চিকিৎসক তার জ্ঞান, শিক্ষা-দীক্ষা সবকিছু নিয়ে দাতা বন্ধুর মতো তার পাশে দাঁড়াবেন, স্বল্পসময়ে, কম কষ্ট দিয়ে স্থায়ী আরোগ্য দান করবেন। এতটুকুই সবার দাবি। কিন্তু চিকিৎসক যদি উপযুক্ত জ্ঞানের অধিকারী না হন, মানবীয় গুণসম্পন্ন না হন, অর্থপাগল হন; তাহলে তার চিকিৎসায় রোগী শুধু শারীরিক-মানসিক বঞ্চনাই পাবে, আরোগ্য নয়।
ডা. স্যামুয়েল হ্যানিম্যান অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসায় ব্যর্থতা দেখে এমডি হয়েও সরে দাঁড়িয়েছিলেন। সুযোগ সন্ধানীর মতো অর্থ উপার্জনে মনোযোগ না দিয়ে সৎভাবে বাঁচার জন্য অনুবাদকর্মে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। তবু পেশার অমর্যাদা করেননি। আজ তাই জন্মদিনে ব্যক্তি ও চিকিৎসক হ্যানিম্যানকে তার মানবতাবাদী চিন্তার জন্ম এবং সহজ ও ফলপ্রসূ একটি চিকিৎসাব্যবস্থা উপহার দেয়ার জন্য শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ ।
লেখক : ডা. হায়দার আলী; বিএসসি, ডিএইচএমএস, ঢাকা।