হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় আরোগ্যে জীবনী শক্তি ও নিউটনের গতি সূত্রের তৃতীয় সূত্র।

হোমিওপ্যাথিতে “জীবনী শক্তি” ও এলোপ্যাথিতে “রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা (ইমিউনিটি)” একই কাজ।
হোমিওপ্যাথির ভাষায় জীবনী শক্তি (Vital Force/ Vital Principle) বা এলোপ্যাথির ভাষায় রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা (Immune System) একই বিষয় হলেও ভিন্ন নামে অভিহিত আরোগ্যকার্যে অদবদ্য ভূমিকা রেখে আসছে। 
যখন কোনো রোগশক্তির প্রতি সংবেদনশীল হয় তখনই মানুষ পীড়িত বা অসুস্থ হয়। প্রতিটি মানুষের মাঝে “আত্মা” ও “জীবনী শক্তি” রয়েছে এবং দুটোই অদৃশ্য সত্ত্বা।

ডা. স্যামুয়েল হ্যানিম্যান “জীবনী শক্তি” মতবাদ গ্রহণ করে হোমিওপ্যাথিতে প্রতিষ্ঠা করেন। এ বিষয়ে বলেন যে, জড় দেহের সকল চেতনা, শক্তি, সামর্থ্য, অনুভূতি, সুখ-দুঃখ অনুভব, চিন্তা-ভাবনা, স্মৃতিশক্তিসহ সকল প্রকার জৈব-ক্রিয়াকলাপের মূলে হলো জীবনী শক্তি। আত্মার অন্তঃপ্রবাহ জীবনীশক্তির মাধ্যমে জীবদেহকে সকল কর্মকান্ডের উপযোগী করে রাখে। আত্মা ও জীবনী শক্তি উভয়ই অদৃশ্য বটে কিন্তু একই জিনিস নয়। স্রষ্টার আদেশ ঘটিত আত্মার অন্তঃপ্রবাহের দরুণ জড়দেহ চেতনা লাভ করে। এই আত্মাটি অমর কিন্তু জীবনী শক্তি ক্ষয়শীল এবং জড়দেহটি ধ্বংসশীল। 
বর্তমানে যে ইমিউনিটি সিস্টেমের (রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা) কথা বলছে তা ডা. স্যামুয়েল হ্যানিম্যান দুইশত বছর আগেই বলে গিয়েছেন। মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ করা, রোগাক্রান্ত হওয়া, রোগযন্ত্রণা ও রোগ লক্ষণ প্রকাশ করা, ইন্দ্রিয় সমূহের মাধ্যমে অনুভূতি গ্রহণ করা এবং রোগে আক্রান্ত হবার পর যথার্থ সদৃশ ঔষধ শক্তির সাহায্যে রোগ আরোগ্য করা ইত্যাদি জীবনী শক্তির প্রধান কাজ। আমরা তখনই পীড়িত হয় যখন আমাদের জীবনীশক্তি কোনো রোগশক্তির প্রতি সংবেদনশীল হয়। সহজ কথায় আমাদের জীবনী শক্তিতে যখন কোনো রোগের প্রতি চাহিদা তৈরী হয় তখন সেই রোগে পীড়িত হই। 
রোগ শক্তির বিরুদ্ধে নাছোড় জীবনী শক্তি (ভাইটাল ফোর্স) অবিরত সংগ্রাম করে চলেছে। সংগ্রামে পরাভুত হলেই সৃষ্টি করে অস্বাভাবিক লক্ষণরাজি। সাহায্যের নিমিত্ত বলবত্তর অধিকতর শক্তিশালী সদৃশ ঔষধ শক্তি যখন জীবনী শক্তির (ভাইটাল ফোর্স) সংস্পর্শে আসে, তখন অপেক্ষাকৃত দুর্বল রোগশক্তি আর টিকে থাকতে পারে না, দ্রুত অপসৃত হয়। ঔষধ শক্তির সীমিত ক্রিয়া শেষ হয়ে গেলে জীবনী শক্তি (ভাইটাল ফোর্স) সম্পূর্ণ মুক্ত হয় ও রোগী আরোগ্য লাভ করে। 
এটাকে হোমিওপ্যাথিকরা বলে থাকে জীবনী শক্তি (ভাইটাল ফোর্স) এর কাজ নামে অভিহিত করে ও এলোপ্যাথরা এটাকে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা (ইমিউনিটি সিস্টেম) কাজ বলে অভিহিত করে আসছে।

রোগ ও ঔষধ দুইটি শক্তি। ঔষধ শক্তির ধর্ম হলো রোগ শক্তিকে আঘাত করা ও প্রতিহত করা। বৈজ্ঞানিক নিয়ম হলো Similar Repels অর্থাৎ সদৃশ প্রতিহত করে। রোগ ও ঔষধ সদৃশ। প্রাকৃতিক রোগের বিরুদ্ধে ঔষধজ কৃত্রিম রোগকে নিযুক্ত করা হলো প্রাকৃতিক সদৃশ নীতিতে উভয়ের মধ্যে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া চলতে থাকে। নিউটনের তৃতীয় সূত্র হলো “প্রত্যেক ক্রিয়ারই সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া রয়েছে”। ডা. স্যামুয়েল হ্যানিম্যান চিকিৎসা শাস্ত্রের বিশ্বজনীন প্রাকৃতিক আরোগ্য নীতি হলোঃ Similia Similibus Curenture” অর্থাৎ সদৃশকে সদৃশ দ্বারা প্রতিহত করে আরোগ্য সাধন করা। 
পৃথিবীতে যা কিছুই ঘটে তা ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ার ফলেই ঘটে থাকে। কাজেই প্রতিটি ঘটনার দুইটি দিক থাকে। একটি ক্রিয়া অপরটি প্রতিক্রিয়া। ক্রিয়া যত বেগে দেওয়া হয়, প্রতিক্রিয়াও তত বেগে দেখা দিবে। এই ক্রিয়া দুই প্রকার। একটি শুভ অন্যটি অশুভ। রোগ মাত্রই অশুভ। এই অশুভ শক্তির ক্রিয়া হতে বাঁচার জন্য দেহের ভিতরে অবস্থিত জীবনী শক্তি প্রতিক্রিয়া চালায়। রোগ শক্তির ক্রিয়া আর জীবনী শক্তির প্রতিক্রিয়া সমান হলে আমরা অসুস্থ হই না। ইহাকে বলে সদৃশ সদৃশকে প্রতিহত করে। অন্যদিকে আকর্ষণ করে। যখন অধিক শক্তিশালী ঔষধ দ্বারা ক্রিয়া প্রদর্শিত হয় তখন রোগের দিক হতে প্রতিক্রিয়ার ভারসাম্যের অভাব ঘটে এবং,রোগের বিপর্যয় ঘটে। ফলে আমরা আরোগ্য লাভ করি।

এজন্য বলা হয় হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা ক্ষেত্র নিউটনের গতি তৃতীয় সূত্রের সমতুল্য। অর্থাৎ প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটা সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে।

১। প্রত্যেক ক্রিয়ার সমান ও সমান বিপরীতধর্মী প্রতিক্রিয়া আছে।

২। জীবনের প্রবাহ সদৃশ বিধান মতে ভিতর থেকে বাহিরের দিকে চলে, উর্দ্ধ থেকে নিম্নদিকে চলে, গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ থেকে কম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের দিকে চলে।

৩। অতিক্ষুদ্রতম ভ্রুণ থেকে প্রত্যেক ব্যক্তি সত্তার জন্ম ভিতর থেকে বাহিরের দিকে। এই পৃথিবীতে দুইটি ব্যক্তি সত্তা কখনই একরুপ হয় না।

৪। লক্ষণ সমূহ তার যাত্রা থেকে বিপরীত মুখে ধাবিত হয়।

৫। ঔষধ সমূহ তার সাদৃশ্যের সঙ্গে ব্যস্ত অনুপাতে প্রয়োজন হয়। সংক্ষেপে রোগের সঙ্গে ঔষধের যত বেশী সাদৃশ্যতা ততকম পরিমাণ ঔষধ তাতে প্রয়োজন হয়।

৬। প্রকৃতিতে কোন পরিবর্তন ঘটাতে সবচেয়ে সূক্ষ্মতম শক্তির প্রয়োজন হয় যদি প্রযুক্ত শক্তির প্রকৃতি একই রকম হয়। চূড়ান্ত পরিমাণ সব-সময় ক্ষুদ্র অথবা ক্ষুদ্রতর হয়।

৭। ক্রিয়াকলাপ সহ অঙ্গের সৃষ্টি ও উন্নয়ন সাধন করে।

৮। স্থিতিস্থাপকতা সমূহ : গতিশীল পূর্বাবস্থায় প্রত্যাবর্তন সীমার মধ্যে প্রযুক্ত বল প্রসারংকের অানুপাতিক। প্রত্যেক গতিশীল রোগ শক্তি বা জীবনী শক্তিকে বিপর্যস্ত করে, তা কেবল গতিশীল ঔষধ শক্তিই জীবনী শক্তিকে স্বাভাবিকতায় ফিরিয়ে নিয়ে আসে, যদি এটা গতিশীল পূর্বাবস্থায় প্রত্যাবর্তন সীমার মধ্যে থাকে।

৯। শব্দের প্রতিধ্বনি সূত্র : যখন দুইটি প্রগতিশীল শক্তির একই ধরনের বৈশিষ্ট্য (বিস্তার গতির হার এরং সময়) নিয়ে একটি জীবন্ত সত্তার মধ্যে একই দিকে চলতে থাকে এবং একটি যদি অপরটির উপর প্রচাপিত হয় তখন বলবত্তরটি- দূর্বলতরটির সত্তাকে প্রচাপিত বা দূর করে দেয় কিন্তু এ সব কিছুই হতে হবে পূর্বাবস্থায় প্রত্যাবর্তনশীল গতিসীমার মধ্যে।

[ Reference : Homoeopathic Book “Organon of Medicine” (Dr. Samule Hahnemann, Germany), “The Lesser Writings” (Dr. Samule Hahnemann, Germany), Practical Key to Homeopathy (Dr. Nazir Hossain, Bangladesh), Website, Others Documents & Reference…]

লেখক পরিচিতি :

ডা. মো. আব্দুস সালাম (শিপলু)
ডিএইচএমএস (রাজশাহী হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল), এমএসএস (এশিয়া ইউনিভার্সিটি)
ডা. আব্দুস সালাম হোমিওপ্যাথি হেলথ কেয়ার, 
“ডাক্তার বাড়ী”, জগন্নাথ পাড়া, শেরপুর, বগুড়া, বাংলাদেশ।
(চিকিৎসক, শিক্ষক, কলামিস্ট ও প্রাক্তন সাংবাদিক)