হ্যানিম্যান পৃথিবীর সবর্শ্রেষ্ট চিকিৎসা বিজ্ঞানী

12936672_1079155608822750_1381255659049608667_nস্যামুয়েল হ্যানিম্যান আজ পযর্ন্ত জন্ম নেওয়া পৃথিবীর সবর্শ্রেষ্ট চিকিৎসা বিজ্ঞানী

(Samuel Hahnemann – the greatest medical scientist ever born)

মহাত্মা স্যামুয়েল হ্যানিম্যান ১৭৫৫ সালের ১০ই এপ্রিল জার্মানীর স্যাক্সোনি প্রদেশের মেইসেন শহরে জন্মগ্রহন করেন, যার অবস্থান ড্রিসডেন শহরের বিশ মাইল উত্তর-পশ্চিমে (পোল্যান্ড এবং চেকোশ্লোভাকিয়ার বর্ডারের কাছে)। তাঁর পুরো নাম ছিল ক্রিস্টিয়ান ফ্রেডরিক স্যামুয়েল হ্যানিম্যান (Christian Friedrich Samuel Hahnemann)। তাঁর পিতার নাম ছিল ক্রিস্টিয়ান গটফ্রাইড হ্যানিম্যান এবং মাতার নাম ছিল জোহান্না ক্রিস্টিয়ানা। তৎকালে মেইসেন শহরটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর কেননা ইহার চার হাজার অধিবাসীর অধিকাংশই ছিল দক্ষ শিল্পী, রসায়নবিদ এবং চিত্রকর। তাছাড়া এই শহরে ছিল একটি বিজ্ঞান একাডেমী, অনেকগুলো কাপড়ের কারখানা এবং ছিল তখনকার দিনের নতুন আবিষ্কার চীনা মাটির আসবাপত্রের একটি ফ্যাক্টরী। সিরামিকের এই কারখানাটি ছিল পুরনো পরিত্যক্ত একটি রাজ প্রসাদে অবসি’ত। হ্যানিম্যানের পিতা চীনা মাটির থালা-বাসনের ওপর ছবি এঁকে জীবিকা নির্বাহ করতেন। সেই সব দিনে সিরামিকের তৈজষপত্রে রঙ এবং স্বর্ণ দিয়ে নক্সা করা এবং ছবি আঁকা ছিল একটি নতুন আবিষ্ককৃত প্রযুক্তি এবং এই কাজে যাদেরকে নিয়োগ দেওয়া হতো তাদেরকে ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করে গোপনীয়তা রক্ষার অঙ্গীকার করানো হতো। হ্যানিম্যানের পিতা ছিলেন একজন সৎ, বিচক্ষণ এবং ধার্মিক ব্যক্তি। ফলে ভালো এবং মন্দ, পাপ এবং পুণ্য, সরলতা এবং কুটিলতা ইত্যাদি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা তিনি বাল্যকালেই হ্যানিম্যানের মনে দৃঢ়ভাবে গেথে দিয়েছিলেন। হ্যানিম্যান ছিলেন তাঁর পিতা-মাতার পাঁচ সনতানের মধ্যে তৃতীয় এবং পুত্রদের মধ্যে সবচেয়ে বড়। শিশুকাল থেকেই তিনি পড়াশুনায় অসাধারণ মেধার পরিচয় দেন বিশেষত ভাষা এবং বিজ্ঞানে। তিনি ইংরেজী, ফরাসী, গ্রিক, ল্যাটিন, সপ্যানিশ এবং আরবী ভাষায় পান্ডিত্য অর্জন করেন। সেকালে ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আরব দেশীয় মুসলিম চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের (ইবনে সীনা, ফারাবী, আল কিন্দি প্রভৃতি) লেখা পুস্তকসমূহ পড়ানো হতো; ফলে কারো পক্ষে সত্যিকারের চিকিৎসক বা চিকিৎসা বিজ্ঞানী হওয়ার জন্য আরবী ভাষা শেখা ব্যতীত কোন উপায় ছিল না। এমনকি মাত্র বারো বছর বয়সে তাঁর ওসতাদের নির্দেশে হ্যানিম্যান তাঁর সহপাঠিদের গ্রীক ভাষা শিক্ষা দিতেন।

বলা হয়েছে বিজ্ঞান এবং গবেষণার দিকে তাঁর ঝোঁক ছিল জন্মগত ; একেবারে মজ্জাগত। পাবলিক স্কুলে পড়াকালীন সময়ে মাস্টার মুলার নামক একজন যথার্থ যোগ্য শিক্ষকের স্নেহ লাভে ধন্য হন যিনি তাকে দৈনন্দিন পাঠ মুখসত না করে হজম করার পরামর্শ দিতেন। যোগ্যতা এবং দক্ষতার কারণে তিনি হ্যানিম্যানকে গ্রিক ভাষার ক্লাশ নিতে অনুমতি দিতেন। ফলে সহপাঠিরা হ্যানিম্যানকে ভালোবাসতো। অতিরিক্ত পড়াশোনার কারণে হ্যানিম্যান মাঝেমধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়তেন এবং তখন এই মহান শিক্ষক তাঁর হোমওয়ার্ক, টিউটোরিয়াল ইত্যাদি মাফ করে দিতেন। হ্যানিম্যানের জন্য তাঁর দরজা ছিল সারাক্ষণ খোলা ; যে-কোন সময় তিনি শিক্ষকের সাহায্য লাভ করতে পারতেন। হ্যানিম্যানের পিতা প্রায়ই তাকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নিতেন, তাড়াতাড়ি আয়-রোজগার করা যায় এমন কোন পেশায় নিযুক্ত করার জন্য। মাস্টার মুলার তাঁর পড়াশোনা অব্যাহত রাখার জন্য বিদ্যালয়ের ফি পযর্ন্ত মওকুফ করে দিয়েছিলেন প্রায় আট বছর এবং নানানভাবে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে-অনুরোধ করে হ্যানিম্যানকে রেখে তাঁর পিতাকে ফেরত পাঠিয়েছিলেন। ১৭৭৫ সালে হ্যানিম্যান পিতার কাছ থেকে কুড়িটি মুদ্রা (thalers) নিয়ে লিপজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। পিতার হাত থেকে নেওয়া এটাই ছিল তাঁর সর্বশেষ টাকা-পয়সা। এজন্য তাকে দোষ দেওয়া যায় না ; কেননা তার আরো অনেক সন্তানাদি ছিল এবং তার যৎসামান্য আয়-রোজগার দিয়ে সকলের জন্য শিক্ষাদীক্ষার ব্যবস্থা করতে হয়েছে।

১৭৭৫ সালে তিনি লিপজিগ ইউনিভার্সিটিতে চিকিৎসা বিজ্ঞান অনুষদে ভর্তি হন। কিন্তু সেখানকার অপ্রতুল সুযোগ-সুবিধার কারণে তিনি হতাশ হয়ে পড়েন ; কেননা সেই ডিপার্টমেন্টের অধীনে না ছিল কোন ক্লিনিক, না ছিল কোন হাসপাতাল। সেখানে অধ্যয়নরত অবস্থায় নিজের জীবিকা নির্বাহের জন্য তিনি অর্থের বিনিময়ে ইংরেজী থেকে জার্মানীতে পুস্তক অনুবাদের খন্ডকালীন কাজ হাতে নেন এবং একজন ধনী গ্রীক ব্যক্তিকে ফরাসী ভাষা শেখাতেন। ফলে অন্যান্য ছাত্রদের সাথে সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে পারতেন না। ১৭৭৭ সালের প্রথমার্ধে চিকিৎসা বিজ্ঞানে উচ্চতর জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্যে এবং বাসতব অভিজ্ঞতা লাভের নিমিত্তে তিনি ভিয়েনা গমণ করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আর্থিক অনটন এবং ডাকাতদের হাতে লুন্ঠিত হওয়ার কারণে নয় মাসের মাথায় কোর্স অসমাপ্ত রেখে ফিরে আসতে বাধ্য হন। তবে রয়েল কলেজের একজন অধ্যাপক হ্যানিম্যানের প্রতিভায় এমনই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, তিনি তাকে রোমানীয়ার গভর্নরের ব্যক্তিগত চিকিৎসকের একটি চাকুরির ব্যবস্থা করে দেন। গভর্নরের ব্যক্তিগত চিকিৎসক এবং গ্রন্থাগারের লাইব্রেরীয়ান হিসেবে তিনি গভর্নরের প্রাচীন মুদ্রার কালেকশান, পুরনো পুস্তকসমূহ এবং পান্ডুলিপিসমূহের একটি ক্যাটালগ তৈরী করে দেন, যা ছিল রসায়ন শাসত্র এবং যাদুবিদ্যার উপর ইউরোপের সবচেয়ে বড় এবং দুর্বল পান্ডুলিপির লাইব্রেরী। এখানে অবস্থানকালীন সময়ে তিনি কয়েকটি ভাষা এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাথে সমপর্কিত কয়েকটি বিজ্ঞান বিষয়ে পান্ডিত্য অর্জন করেন।

তিনি আরলেঙ্গেন ইউনির্ভার্সিটিতে তাঁর শেষ সেমিষ্টার অধ্যয়নের পর পেশীর আক্ষেপের (Cramps) ওপর একটি থিসিস পেপার জমা দেন এবং চিকিৎসক হিসেবে এম.ডি. ডিগ্রি লাভ করেন। আরলেঙ্গেন ইউনির্ভাসিটি থেকে তাঁর রেজিস্ট্রেশন লাভের পেছনের কারণ ছিল একটাই আর তা হলো তিনি জানতে পেরেছিলেন যে আরলেঙ্গেনের ফি সবচেয়ে কম। ১৭৮১ সালে তিনি ম্যান্সফিল্ডের তামার খনি এলাকার নিকটবর্তী একটি গ্রামের ডাক্তারের চাকুরি নেন। ১৭৮০ থেকে ১৭৮৩ সালের মধ্যে তিনি চিকিৎসক হিসেবে বেশ কয়েকটি চাকুরিতে যোগদান করেন কিন্তু ১৭৮২ সালে তাঁর বিয়ের পর থেকেই চিকিৎসা বিজ্ঞানের অপূর্ণতা এবং ব্যর্থতা লক্ষ্য করে ডাক্তারী পেশার প্রতি ধীরে ধীরে আকর্ষণ হারিয়ে ফেলতে থাকেন। কেননা তিনি লক্ষ্য করেন যে, ঔষধের ক্ষতিকর পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ার ফলে রোগীদের স্বাস্থ্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, অধিকাংশ রোগই ঔষধে নিরাময় হয় না, যে-রোগ তিনি সারিয়ে দিচ্ছেন একই রোগ নিয়ে কয়েক মাস অথবা কয়েক বছর পরে রোগীরা পুণরায় ফিরে আসছে ইত্যাদি ইত্যাদি। ফলে ১৭৮৪ সালে ড্রিসডেন শহরে পৌঁছানোর পর তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে ডাক্তারী পেশা বর্জন করেন এবং তাঁর ক্রমবর্ধিষ্ণু পরিবারের সৎ উপায়ে ভরণপোষনের জন্য পুণরায় ফুল-টাইম ভিত্তিতে অনুবাদকের পেশা গ্রহন করেন।

১৭৮২ সালের শেষের দিকে হ্যানিম্যান মিস কাচলারকে (spinster Johanna Henrietta Leopoldina Kuchler) বিয়ে করেন। হ্যানিম্যান তাঁর ঝঞ্ঝা-বিক্ষুদ্ধ জীবনে আকর্ষণীয়া এই তরুণীর মধ্যে যেন তাঁর অনন্তকালে প্রিয়াকে খুঁজে পান। হ্যানিম্যান তাকে সোহাগ করে ইলিজ (Elise) নামে ডাকতেন যা সত্রীর নিকট লেখা তাঁর অনেক পত্রে দেখা গেছে। সেইন্ট জন-এর গীর্জার ম্যারিজ রেজিস্টারে উল্লেখ ছিল, “অদ্য পহেলা ডিসেম্বর ১৭৮২ সালে, সেন্ট জনস চার্চে, মিঃ স্যামুয়েল হ্যানিম্যান, ডক্টর অব মেডিসিন, গুমেরানের (Gommern) স্থানীয় নির্বাচিত স্যাক্সন গীর্জা পল্লীর ডাক্তার, বয়স ২৮ বছর, মেসেনের সিরামিক ফ্যাক্টরীর চিত্রশিল্পী মিঃ ক্রিস্টিয়ান গটফ্রাইড হ্যানিম্যান এবং তার সত্রী জোহান্না ক্রিশ্চিয়ানা-র ঔরসজাত পুত্র, বিবাহসুত্রে আবদ্ধ হন প্রয়াত গটফ্রাইড হেনরী কুচলার এবং তার সত্রী মার্থা সোফিয়া-র ঔরসজাত কন্যা মিস সিপনস্টার জোহান্না হেনরিয়েটা লিওপোল্ডিনা কাচলার-এর সাথে”। বিয়ের পর গুমারনেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন এবং ১৭৮৩ সালের শেষের দিকে অথবা ১৭৮৪ সালের প্রথম দিকে তাঁর প্রথম (কন্যা) সন্তান হেনরীয়েটা (Henrietta) জন্মগ্রহন করে।

চিকিৎসা বিজ্ঞানের ওপর তিনি যেই বৈপ্লবিক আবিষ্কার সমপন্ন করেন তা প্রথম তাঁর মাথায় আসে ১৯৭০ সালে উইলিয়াম কালেন (William Cullen)-এর মেটেরিয়া মেডিকা অনুবাদ করার সময়। উক্ত পুস্তকে লেখা ছিল যে, কুইনাইন (Cinchona) মেলেরিয়া জ্বরের সুনির্দিষ্ট ঔষধ, কেননা এটি সুস্থ মানুষ খেলে তার শরীরের ম্যালেরিয়া জ্বর উৎপন্ন করতে পারে। বিষয়টি হ্যানিম্যানের বিশ্বাস হয় নাই ; ফলে তিনি সুস্থ শরীরে অল্লমাত্রায় কয়েকদিন সিনকোনা খেয়ে শরীরের তার ক্রিয়া পরীক্ষা করেন। তিনি বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করেন যে, সত্যিসত্যি ম্যালেরিয়ার মতো কাঁপুনি দিয়ে শুরু হওয়া সবিরাম জ্বর তাঁর শরীরে সৃষ্টি হয়েছে। এই সময় তিনি যেই এলাকায় বসবাস করতেন, তা ছিল ম্যালেরিয়া উপদ্রুত অঞ্চল। ফলে তিনি নিশ্চিত হওয়ার জন্য ম্যালেরিয়ামুক্ত এলাকায় গিয়ে পুণরায় সুস’ শরীরে সিনকোনা খেয়ে একই ফল পেলেন। ইহার পর তিনি আরো অনেকবার একই পরীক্ষা করে একই রেজাল্ট পান। তিনি তাঁর এই নতুন আবিষ্কারকে নাম দেন সদৃশ বিধান বা হোমিওপ্যাথি (homeopathy)। ল্যাটিন শব্দ homeo -এর অর্থ সদৃশ বা একই রকম এবং pathy অর্থ ভোগান্তি বা অসুখ। তিনি তাঁর এই বৈজ্ঞানিক সুত্রকে সংজ্ঞায়িত করেন এভাবে যে, “সদৃশ সদৃশকে নিরাময় করে” (Like cures like)। ল্যাটিন ভাষায় বলা হয় similia similibus curentur. অর্থাৎ যে ঔষধ সুস’ শরীরে যে-রোগ সৃষ্টি করতে পারে, সেই ঔষধ অল্প মাত্রায় খাওয়ালে তা একই রোগ নিরাময় করতে পারে। আবার উল্টো করে বললে বলা যায় যে, যে ঔষধ যে রোগ সারাতে পারে, সেই ঔষধ সুস’ শরীরে খেলে একই রোগ তৈরীও করতে পারবে। হোমিওপ্যাথির বৈজ্ঞানিক এবং দার্শনিক ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছে রোগী পর্যবেক্ষণের (observation of the sick) ওপর ভিত্তি করে।

এসময় ড্রিসডেনেও তিনি একটু-আধটু ডাক্তারী করতেন, তবে তা জীবিকা অর্জনের জন্য ছিলো না বরং তা ছিলো প্রচলিত এলোপ্যাথিক চিকিৎসার অকার্যকারীতা এবং ক্ষতিকারক দিক নিয়ে গবেষণার উদ্দেশ্যে। ১৭৮৪ সালে তিনি Demarchy-র The Art of Manufacturing Chemical Products বইটি ফরাসী ভাষা থেকে জার্মান ভাষায় অনুবাদ করেন। এটি ছিল দুই খন্ডের একটি বিশাল অনুবাদ কর্ম যাতে তিনি নিজে থেকে অনেক কিছু যোগ করেছেন। এই কাজের জন্য স্বেচ্ছায় তাকে অনেক অভাব-অনটন সহ্য করতে হয়েছে এবং দারিদ্রের বিরুদ্ধে জেহাদ করতে হয়েছে। কেননা অনুবাদের কাজে তিনি খুবই সামান্য অর্থ উপার্জন করতে পারতেন। ডিমারকি ছিলেন সেকালের একজন শ্রেষ্ট রসায়নবিদ (chemists)। ফ্রেঞ্চ একাডেমী তার বইটি ছাপিয়েছিল যাতে জনগণ কেমিক্যাল দ্রব্যাদির উৎপাদন কৌশল আয়ত্ত করতে পারে। কেননা তৎকালে অধিকাংশ ক্যামিকেলের উৎপাদনকারী ছিল ওলন্দাজরা (Dutch) এবং বাণিজ্যিক কারণে তারা এসব ব্যাপারে খুবই গোপণীয়তা বজায় রাখতো। হ্যানিম্যানও বইটিকে জার্মান ভাষায় অনুবাদের মাধ্যমে দেশবাসীর বিরাট উপকার করেছিলেন। বইটি অনুবাদের পাশাপাশি এতে তিনি নিজে থেকে অনেক তথ্য পাদটিকা আকারে সংযুক্ত করে দিয়েছেন, ত্রুটিগুলি সংশোধন করে দিয়েছেন, অসম্পূর্ণ তথ্যকে সম্পূর্ণ করে দিয়েছেন ; যা পড়লে রসায়ন শাস্ত্রে এই তরুণ চিকিৎসকের অসাধারণ পান্ডিত্যের পরিচয় পাওয়া যায়। antimonials, lead, quicksilver, camphor, succinic acid, borax ইত্যাদির ব্যাপারে তিনি দশজন লেখকের উদ্ধৃতি দিয়েছেন। ডিমারকি যেখানে বলেছেন যে, carbonification of turf-এর ওপর কোন গবেষণার কথা তার জানা নেই, হ্যানিম্যান সেখানে ছয়টি গবেষণার উল্লেখ করেছেন। ডিমারকি একজন বিখ্যাত জার্মান চিকিৎসকের কথা উল্লেখ করেছিলেন ; হ্যানিম্যান তার নাম, বইয়ের নাম এবং সংশ্লিষ্ট পরিচ্ছদেরও উল্লেখ করেছেন। মোটামুটি বইয়ের প্রতি পৃষ্ঠাতেই তার ফুটনোট চোখে পড়ে। ক্যামিকেল ছাঁকন বা উত্তপ্ত করার পাত্র (retorts) তৈরীতে হ্যানিম্যান নতুন দিকনির্দেশনা প্রদান করেন ; যাতে মনে হয় বিভিন্ন দেশে কেমিকেল উৎপাদনের পদ্ধতির সাথে তাঁর পরিচয় ছিল। রাশিয়া, সুইডেন, জার্মানী, ইটালি, সিসিলি প্রভৃতি দেশে এলুমিনিয়ামের (alum) ব্যবহারের বিষয়ে ডিমারকি’র ভুল তথ্যকে হ্যানিম্যান সংশোধন করে দেন। Annalen নামক একটি বিখ্যাত কেমিকেল সাময়িকীর সম্পাদক Crell লিখেছিলেন যে, “আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি যে, রসায়ন শাস্ত্রের ওপর ইহার চাইতে উন্নত, পুর্ণাঙ্গ এবং প্রামান্য গ্রন্থ আর দ্বিতীয়টি নেই”। ১৭৮৫ সালে ডিমারকির Art of Distilling Liquor নামক বইটিও হ্যানিম্যান অনুবাদ করে দুই খন্ডে প্রকাশ করেন।

১৭৮৪ সালে দুরারোগ্য ক্ষতের (scrofulous sores) চিকিৎসার ওপর তাঁর একটি মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এতে তিনি লিখেন যে, “একটি খুবই সত্য কথা (এবং যা আমাদেরকে বিনয়ী হতে সাহায্য করে) যে, সাধারণ, প্রাকৃতিক এবং কৃত্রিম যে-সব বস্তু ঔষধরূপে ব্যবহৃত হয়, তাদের অধিকাংশেরই গুণাগুণ জানা গেছে সাধারণ মানুষের প্রাত্যাহিক ব্যবহার থেকে (অর্থাৎ দাদী-নানীদের কাছ থেকে)। আর এই কারণে বিজ্ঞ চিকিৎসকদের নিকট এসব গৃহ ব্যবহৃত ঔষধের গুরুত্ব অপরিসীম”। এই বইটি ছিল প্রধানত ট্রান্সসিলভানিয়ায় বসবাস কালীন সময়কার তাঁর অভিজ্ঞতার ফসল। সেই সময়কার ডাক্তাররা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাকে কোন গুরুত্ব দিতেন না। এই কারণে হ্যানিম্যান তাঁর এই পুস্তকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, ব্যায়াম, মুক্ত বায়ু সেবন, স্থান পরিবর্তন, ঠান্ডা পানির ঔষধি গুণ, সমূদ্র সৈকতে গমণ ইত্যাদির গুরুত্ব বুঝাতে অনেকগুলো পৃষ্টা ব্যয় করেন। তাঁর এই বইটি সমকালীন চিকিৎসক সমাজে বেশ সমাদর লাভ করে। লেখালেখি এবং অনুবাদে সাধারণত আয়-রোজগার খুবই কম হয়। এই কারণে ১৭৯০ সালের দিকে তিনি ভয়ানক দরিদ্রে পরিণত হন এবং দারিদ্র তাকে লিপজিগ ছেড়ে স্টোটারিজ শহরে গমণ করতে বাধ্য করে। এসময় ড্রিসডেন ইকোনোমিক্যাল সোসাইটি তাকে ফরাসী এবং ইংরেজী থেকে জার্মান ভাষায় বিজ্ঞান এবং চিকিৎসা বিষয়ক পুস্তক অনুবাদে প্রশংসনীয় অবদানের জন্য বিশেষভাবে সম্মাণনা প্রদান করে। ফলে চিকিৎসক হিসেবে তাঁর পরিচিতি ঢাকা পড়ে গিয়েছিল এবং অনুবাদক ও লেখক হিসেবে তাঁর সুনাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছিল। ফলে লিপজিগ থেকে তাঁর কাছে একটার পর একটা অনুবাদের অর্ডার মুষলধারে বৃষ্টির মতো আসতে লাগল। যদিও প্রাগ্য-বিদগ্ধ সমাজের পক্ষ থেকে প্রচুর স্বীকৃতি-সম্মানণা তাঁর ওপর বর্ষিত হচ্ছিল, তথাপি এই প্রতিভাশালী এবং উচ্চাকাংখী ব্যক্তির আত্মাকে তা কি তৃপ্ত করতে পারছিল ? এই সমপর্কে হ্যানিম্যান নিজে লিখেছেন যে, “ড্রিসডেন শহরে অবস্থানকালীন সময়ে আমি উল্লেখযোগ্য কোন কাজ সম্পাদন করিনি”। অর্থাৎ তিনি বলতে চেয়েছেন যে, তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নয়ণে এসময় কোন অবদান রাখতে পারেননি ; কেননা তিনি কেবল প্রচলিত চিকিৎসা বিজ্ঞানের গ্রন্থসমূহ অনুবাদ করেছেন এবং পরিবারের ভরণ-পোষণ করেছেন।

প্রথম সত্রীর মৃত্যুর চার বছর ছয় মাস পর ১৮৩৫ সালের ১৮ই জানুয়ারী হ্যানিম্যান দ্বিতীয় বিয়ে করেন মেলানি’কে (Melanie D’Hervilly Gohier)। সে ছিল ফ্রান্সের এক সুন্দরী, আকর্ষণীয়া তরুণী আর্টিস্ট। মেলানী প্রথমে ছিলেন হ্যানিম্যানের রোগী, তারপরে ছিলেন হোমিওপ্যাথির ছাত্রী এবং শেষে ছিলেন প্রেমিকা এবং সত্রী। মেলানী বয়সে ছিলেন হ্যানিম্যানের চাইতে চল্লিশ বছরের ছোট। মেলানী ১৮৩৪ সালের ৮ই অক্টোরব প্রথম যখন চিকিৎসার জন্য ফ্রান্স থেকে জার্মানীর কোহেন নগরে হ্যানিম্যানের চেম্বারে এসে উপসি’ত হন, তখন তিনি যারপর নাই বিস্মিত হয়েছিলেন এই তরুণীর কর্মকাণ্ড দেখে। জার্মানীর কোহেন নগরীতেই তাদের বিয়ে হয় এবং জানুয়ারীতে বিয়ের পর জুন মাসের ৭ তারিখে তিনি দেশত্যাগ করে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে বসবাস শুরু করেন। মানবজাতিকে রোগমুক্ত করার মানসে তাঁর এই হিজরত ছিল অনেকটা আরব্য রজনীর রূপকথার মতো। তিনি জানতে পেরেছিলেন যে, ব্যতিক্রমধর্মী অসাধারণ প্রতিভাসমপন্ন ব্যক্তিদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার সবচেয়ে বেশী স্বাধীনতা দেওয়া হয়ে থাকে প্যারিসে। তাদের এই অদ্ভুত এবং বিম্মিয়কর প্রেম এবং বিয়ের ঘটনা জার্মানীর পত্র-পত্রিকায় ব্যাপক প্রচার পাওয়ায় অভদ্র প্রতিবেশী এবং বৈরী ভাবাপন্ন চিকিৎসক সমাজের পক্ষ থেকে তাদের প্রতি বৃষ্টির মতো অপমানজনক ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ নাজিল হতে লাগলো। হ্যানিম্যানের প্যারিস গমণের পর তাঁর কন্যারা এসে পিত্রালয়ে বসবাস করা শুরু করে এবং মৃত্যু পযর্ন্ত তারা সেখানেই বসবাস করেছে। তারা তাদের সৎমা মেলানীকে তেমন পছন্দ করতো না। মেলানীর কর্মকাণ্ড বা উদ্দেশ্য সমপর্কে আমরা যাহাই বলি না কেন, হ্যানিম্যান তাঁর বন্ধু-বান্ধবদের নিকট অনেক চিঠিতেই লিখেছিলেন যে, মেলানীর ভালবাসা এবং সেবা-যত্নে তিনি বর্তমানে খুবই সুখী জীবন-যাপন করছেন। প্যারিসে হ্যানিম্যানের জীবনের এই শেষ আট বছরে তিনি ছিলেন একজন বিশ্বখ্যাত মহাব্যসত ডাক্তার এবং তাঁর তরুণী সত্রী ছিল তাঁর সহকারী চিকিৎসক। এসময় ধনী, বিত্তশালী এবং ক্ষমতাশালী ব্যক্তিদের সবচেয়ে পছন্দের ডাক্তার ছিলেন হ্যানিম্যান। বর্ণনামতে, এই আট বছরে হ্যানিম্যান ও মেলানী দুইজনে মিলে আয় করেছিলেন আট লক্ষ ফ্রাঙ্ক। পাশাপাশি দরিদ্র রোগীদের তিনি চিকিৎসা করতেন বিনা পয়সায় ; তাদের নিকট থেকে ফি এবং ঔষধের মুল্য কোনটাই রাখতেন না। মেলানী তাঁর কর্মকাণ্ডের জন্য চিরকালই একজন রহস্যময় নারী হিসেবেই থেকে যাবেন। তাঁর শত্রুদের মতে, “মেলানী একজন উচ্চাভিলাসী, স্বার্থপর, সুযোগসন্ধানী এবং ধান্ধাবাজ বুদ্ধিজীবি মহিলা ছিলেন……বিশেষত সেই ভদ্র, দুরদৃষ্টিসমপন্ন এবং রোমান্টিক পুরুষটির (হ্যানিম্যান) জন্য যে তাকে ভালবাসত”। মেলানী কখনও হ্যানিম্যানের পাশ ছাড়তেন না। তিনি হ্যানিম্যানের রোগীলিপিগুলি (casebooks) মুখসত করেছিলেন। মেটেরিয়া মেডিকা পিউরা’র (Materia Medica Pura) অনেক জটিল লক্ষণ এবং দুর্লভ নোট ছিল তাঁর নখদর্পণে যা হ্যানিম্যানের অন্যকোন ছাত্রের পক্ষে সম্ভব ছিল না। ফলে তিনি হোমিওপ্যাথির একজন জীবনত বিশ্বকোষে (encyclopaedia) পরিণত হন। মেলানী সবচেয়ে বেশী বিতর্কিত হন দুটি কাজের মাধ্যমে ; একটি হলো হ্যানিম্যানের মৃত্যুর পর কাউকে না জানিয়ে তাড়াতাড়ি অতি গোপনীয়তার সাথে হ্যানিম্যানকে দাফন করা এবং দ্বিতীয়ত হ্যানিম্যান রচিত অর্গাননের ষষ্ট সংষ্করণ প্রকাশ না করে প্রায় সত্তর বছর লুকিয়ে রাখা। গবেষকদের মতে, মৃত্যুর পুর্বে হ্যানিম্যান ইসলাম গ্রহন করে মুসলিম হয়েছিলেন ; হয়ত হ্যানিম্যানের ইচ্ছা অনুযায়ী তাকে খ্রিষ্টান ধর্ম মতে দাফন না করার জন্যই মেলানী তড়িগড়ি করে গোপনে (মুসলিম কায়দায়) সমাহিত করে থাকতে পারেন। কিন্তু অর্গাননের ষষ্ট সংষ্করণ প্রকাশ না করে কেন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতিকে থামিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, তার কারণ আজও অজানা। (উল্লেখ্য, হ্যানিম্যান অর্গাননের ষষ্ট সংস্করণ সমপূর্ণ রচনা করা সত্ত্বেও হঠাৎ মৃত্যুবরণ করায় নিজে তা প্রকাশ করে যেতে পারেন নাই।)

শেষ বয়সে হ্যানিম্যানের শরীর পাতলা (চিকন) এবং বেটে-খাটো হয়ে গিয়েছিল। হাঁটু সামান্য বেঁকে গিয়েছিল এবং তাঁর শরীরের মধ্যাংশও কিছুটা সামনের দিকে বেঁকে গিয়েছিল যার ফলে পুরোপুরি খাড়া-সোজা হয়ে দাঁড়াতে তাঁর কোন অসুবিধা হতো না। ১৮৪৩ সালের ২রা জুলাই প্যারিসে হ্যানিম্যান ইনেতকাল করেন ব্রঙ্কাইটিস রোগে (ইন্নালিল্লাহে……রাজেউন) এবং মন্টমার্ট্রিতে (Montmartre) তাকে সমাহিত করা হয়। পরে আমেরিকান হোমিও ডাক্তাররা অর্থ ব্যয় করে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে আরেকটি অভিজাত গোরস’ানে (Cimitiêre Pere Lachaise) পুণরায় দাফন করেন, যেখানে অনেক বিখ্যাত লোকদের কবর ছিল। ইউরোপ, রাশিয়া, ইন্ডিয়া এবং আমেরিকাতে অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতি ছড়িয়ে পড়েছিল প্রধানত (অর্ধেকটা হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতির বিরুদ্ধে ব্যাপক অপপ্রচারের জন্য এবং বাকীটা হোমিও চিকিৎসার যাদুকরী রোগ নিরাময় ক্ষমতার কারণে)। হোমিওপ্যাথির প্রচার-প্রসারে প্রতিটি দেশেরই ধনী এবং ক্ষমতাশালী ব্যক্তিরা সক্রিয় সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন।

লিখেছেনঃ ডাঃ বশির মাহমুদ ইলিয়াস

( প্রতি মুহুর্তের চিকিৎসা বিষয়ক খবর গুলো নিয়মিত পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিন ) https://www.facebook.com/ZamanHomeoHall

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *