৮টি জীবন রক্ষাকারী দক্ষতা সম্পর্কে জেনে নিন

male-human-body

সভ্যতার আদিকাল থেকেই মানুষ ক্রমাগত অনুসন্ধান করেছে বেঁচে থাকার কিংবা অন্যের জীবন বাঁচানোর নানা কৌশল। প্রাত্যহিক জীবনকে সহজতর করার ক্ষেত্রেও মানুষ এগুলো আয়ত্তে এনেছে দিনের পর দিন পরিশ্রমের আর চিন্তার বিকাশমান অবস্থার ভেতর দিয়ে।
এ যুগের চলচ্চিত্রসহ নানা মাধ্যমে এ নিয়ে কাজও হয়েছে। আপনার ছোটবেলায় দেখা ‘ম্যাগাইভার’ নামে একটি টিভি সিরিজের কথা হয়তো এখনই মনে করতে পারবেন। তারপরও সিনেমা দেখার সময় কৌশলগুলি আয়ত্ত করার চেয়ে বিনোদনের দিকেই মনোযোগ থাকে বেশি। ফলে অনেক কিছুই স্মৃতির ফাঁকফোঁকর দিয়ে বেরিয়ে যায়।
যাই হোক, আমাদের জরুরি অনেক মুহূর্তে আমরা প্রয়োজন বোধ করি এমন কিছু কুশলী বুদ্ধির প্রয়োজনীয়তা- যা নিজের জন্য তো বটেই, অন্যের জীবন বাঁচাতেও ভূমিকা রাখতে পারে। আপনার কোন নিকটজন হয়তো হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়েছে। জরুরি সাহায্য আসার যথেষ্ট দেরি। কি করবেন আপনি এ সময়ে? জেনে নিন এরকম কিছু ক্ষেত্রে নানা কৌশল সম্পর্কে।

ধরুন, আপনার পাশের কেউ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। এ রকম কোনো কাজের শুরুতে প্রথমেই যে জিনিসটি আপনার করা উচিৎ তা হলো, জরুরি সাহায্যের জন্য কল করা। অথবা যদি আশপাশে কেউ থাকে তবে নিশ্চিত হোন- তারা কেউ কোথাও ফোন করেছে কি না। যদি না করে থাকে তবে প্রয়োজনীয় জায়গায় ফোন করার কাজটি সেরে ফেলুন।
জরুরি সাহায্য আসার ফাঁকে বসে না থেকে আপনি দেখতে পারেন- এই সময়ের মধ্যে সাহায্য প্রার্থীর জন্য অন্য কোনো সাহায্য করতে পারেন কি না। সঙ্গে আপনার নিজের নিরাপত্তার বিষয়টিও ভাবুন।

মনে রাখবেন, আপনাকে জরুরি মেডিক্যাল টেকনিশিয়ান হওয়ার প্রয়োজন নেই; কিংবা প্রয়োজন নেই জীবন বিপণ্ন হওয়ার পথে- এমন কারো জীবন রক্ষার জন্য পেশাদার চিকিৎসক হওয়ার। এ doctor_abdul_bari_photo_15219জন্য অনুসরণ করুন নিচের বিষয়গুলো :

হৃৎস্পন্দন বন্ধ হলে : ‘জীবন রক্ষাকারী দক্ষতা’র বিষয়টি ভাবতে গেলে প্রথমেই যে বিষয়টি মনে আসে তা হলো, সিপিআর বা কার্ডিয়োপালমোনারি রিসালিটেশন। এটি এমন এক কৌশল- যে পদ্ধতিতে কারো শ্বাস-প্রশ্বাস বা হৃত্স্পন্দন বন্ধ হয়ে গেছে- এমন কাউকে বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করা যায়।

শুধু চিকিত্সক বা সেবিকা নন, যেসব কর্মী জরুরি দায়িত্ব পালন করেন—যেমন, পুলিশ, অগ্নিনির্বাপণকর্মী, শিক্ষক, মা-বাবা এমনকি অন্য যে কোনো ব্যক্তি এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে রাখতে পারেন।

এ পদ্ধতিতে সাহায্যকারী ব্যক্তি হৃত্স্পন্দন বন্ধ হয়ে গেছে এমন ব্যক্তির মুখে মুখ লাগিয়ে জোরে বাতাস ঢোকানোর চেষ্টা করবেন, যেন ফুসফুসে অক্সিজেন পৌঁছে যায়। যদিও সরাসরি মুখে মুখ না লাগিয়ে বিশেষ মাস্ক ব্যবহার করা যায়। এভাবে দুবার ফুঁ দিতে হবে। এরপর ওই ব্যক্তির বুকের ওপর এক হাতের ওপর অন্য হাত রেখে দুই হাতের সাহায্যে চাপ দিতে হবে।

এতে হার্টের অক্সিজেনযুক্ত রক্ত দেহের গুরুত্বপূর্ণ অংশে প্রবাহিত হবে। এভাবে বুকের ওপর মিনিটে ১শ বার হিসেবে অন্তত ৩০ বার প্রায় দুই ইঞ্চি গভীরে চাপ দিতে হবে। এরপর আবারও দুবার মুখে মুখ লাগিয়ে ফুসফুসে বাতাস ভরতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত চিকিত্সক, অক্সিজেন নল, অক্সিজেন ব্যাগ, সিলিন্ডার ও অ্যাম্বুলেন্স না পাওয়া যাচ্ছে এ প্রক্রিয়া চালাতে থাকুন।1476468_10152000144853468_785867060_n

কি করবেন হার্ট অ্যাটাক হলে: আমাদের হৃৎপিণ্ড আসলে সারা শরীরে রক্ত সরবরাহকারী একটি পাম্প। এটি চলে আমাদের শরীরের মধ্যে তৈরি এক বিশেষ জৈব-বিদ্যুতের সাহায্যে। এই বিদ্যুৎ সরবরাহে গোলযোগ দেখা দিলে অনেক সময় শুরু হয় ভেন্ট্রিকুলার ট্যাকিকার্ডিয়া। এর ফলে হার্টের ভেন্ট্রিকল বা নিলয় প্রকোষ্ঠ দুটির স্পন্দন প্রচণ্ড বেড়ে গিয়ে মিনিটে প্রায় চার শ’ হয়ে যায়।

এরপর হৃৎস্পন্দন কমে আসে। এতটাই কমে যে হৃৎপিণ্ড আর রক্ত সরবরাহ করতে পারে না। এ অবস্থাকে বলে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট। এ অবস্থায় জরুরি প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবে সিপিআর দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে রোগির বয়স যদি ১৬ বছরের ওপরে হয়, যদি এটি অ্যালার্জির কারণে হয়ে থাকে অথবা এ নিয়ে কোনো চিকিৎসা চলমান না থাকে- তবে তাকে অ্যাসপিরিন দেওয়া যেতে পারে।

বিষম লেগে শ্বাসরোধের মতো অবস্থা হলে: রেস্টুরেন্টে কিংবা বাসায় খাবার গ্রহণকালে অনেক সময় খাবার বিষম লেগে খাদ্যনালি আটকে যায়। খাবার ছাড়া অন্য কোন বস্তুতেও অনেক সময় গলায় আটকে যায়। এ ক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তিকে পেছন থেকে ভালো করে জাপটে ধরুন। দুই হাত আক্রান্ত ব্যক্তির পেটের নিচে বেঁধে রাখুন। এবার হাতের বন্ধনী দিয়ে কিছুটা শূন্যে তুলে আলতো করে বেশ কয়েকবার চাপতে থাকুন।1011892_594612100583388_919143703_n

বাচ্চাদের বেলায়ও চাপ দিতে হবে তবে তা বড়দের মতো নয় এবং শূন্যে তোলা যাবে না। প্রথমে হাঁটু গেড়ে বসুন। তারপর ডান হাতের ওপর বাচ্চাকে চিৎ করে শুইয়ে বাম হাতের তিন আঙ্গুল ব্যবহার করে বাচ্চার বুকের নীচে জোরে জোরে তবে বাচ্চার জন্য সহনীয় পর্যায়ে ৫ বার চাপ দিন।

কেউ ডুবে যেতে থাকলে কিভাবে রক্ষা করবেন: দুর্ঘটনাজনিত কারণে মৃত্যুর ঘটনার মধ্যে ডুবে যাওয়া অন্যতম। বিশেষ করে বাচ্চাদের বেলায় এটি ঘটে থাকে বেশি। আপনি যদি দক্ষ সাতারু না হন তবে ডুবে যাচ্ছে- এমন কাউকে উদ্ধার করা আপনার জন্য কঠিন। এ ক্ষেত্রে আপনি যেটা করতে পারেন তা হলো- যদি ডুবন্ত লোকটি ডাঙার কাছাকাছি থাকে তবে চ্যাপ্টা তক্তা জাতীয় কিছু একটা তার দিকে দিয়ে তার কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করুন। এ ছাড়া ব্যবহার করতে পারেন গাছের ডাল, বৈঠা, গামছা, কিংবা লম্বা বাঁশের মতো কোন কিছু।

ছুড়ে দিতে পারেন সেফটি রিং, তা না হলে আপনার গায়ের শার্টটি খুলে ব্যবহার করতে পারেন এ কাজে। আর যদি কাছেই পেয়ে যান একটি নৌকা তবে দ্রুত চলে যান আক্রান্ত লোকটিকে উদ্ধারে। আসলে এ বিষয়গুলি আপনিও হয়তো জানেন। তবে প্রয়োজন হচ্ছে এগুলো নিয়ে মাঝেমধ্যে চিন্তা করা এবং ঘটনা সংঘটিত হওয়ার সময় মাথা ঠাণ্ডা রেখে উপায়টি বের করা।

কিভাবে করবেন রক্তপাতের চিকিৎসা: রক্তপাত অনেক রকম হতে পারে। হতে পারে সাধারণ কিংবা মারাত্মক রক্তপাত। বেশি মারাত্মক হয় যখন কোন শিরা বা ধমনী কাটা পড়ে। যে রকমই হোক- আপনার লক্ষ্য থাকবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রক্তপাত বন্ধ করা। সে জন্য আপনাকে প্রথমে হাত ভালো করে পরিষ্কার করে ধুয়ে নিতে হবে। সম্ভব হলে হাতে পরে নিতে পারেন দস্তানা। পরিষ্কার কোনো প্লাস্টিকের ব্যাগ হলেও চলবে।

এবার যা করতে হবে: আক্রান্ত লোকটিকে শুইয়ে দিন। কাপড় দিয়ে পুরো শরীর ঢেকে দিন। রক্তপাতের স্থানটি ভালো করে পরিষ্কার করুন। আক্রান্ত স্থান থেকে ময়লা ও আটকে থাকা কোনো বস্তুর ভগ্নাবশেষ দূর করুন। তবে বিদ্ধ হয়- এমন কোন বস্তু বা উপকরণ এ কাজে ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন।

যতক্ষণ না রক্তপাত বন্ধ হয়, ততোক্ষণ পরিষ্কার কাপড় অথবা ব্যান্ডেজ দিয়ে ক্রমাগতভাবে অন্তত ২০ মিনিট চাপতে থাকুন। আক্রান্ত স্থান হাত বা পায়ে হলে তা ওপরের দিকে তুলে ধরে আক্রান্ত স্থান চেপে ধরুন। প্রয়োজন হলে আরো গজ নিন। এতেও যদি রক্তপড়া বন্ধ না হয় তবে সংশ্লিষ্ট শিরায় চাপ দিতে থাকুন।

আগুনে পুড়লে কি করবেন: ব্যাপক ও মারাত্মকভাবে পুড়ে গেলে পেশাদার ডাক্তার দেখানো উচিৎ। তবে কাছাকাছি চিকিৎসক পাওয়া না গেলে তাৎক্ষণিকভাবে প্রাথমিক চিকিৎসা করা যেতে পারে। আগুনে পোড়ার সাথে সাথে দশ মিনিট ধরে আক্রান্ত স্থানে ঠাণ্ডা পানি ঢালতে থাকুন। এভাবে স্থানটি ঠাণ্ডা হতে দিন।

আক্রান্ত স্থানে বরফ, মাখন বা অন্য কিছু লাগাবেন না। হালকা সাবান আর ট্যাপের পানিতে আলতো করে স্থানটি পরিস্কার করে ফেলুন। যন্ত্রণা উপশমের জন্য এ্যাসিটামিনোফেন বা ইবুপ্রোফেন দেওয়া যেতে পারে। তবে সাধারণ পোড়া হলে আক্রান্ত স্থানে ড্রেসিংয়ের প্রয়োজন নেই।

গাড়িতে বাচ্চা প্রসবের প্রয়োজন হলে: বাচ্চা প্রসব করানো- একটি স্পর্শকাতর বিষয়। যথাযথ অভিজ্ঞতা না থাকলে এ কাজে যাওয়া ঠিক নয়। তবে গাড়ির ভেতর আপনার স্বজনের প্রসব বেদনা উঠলে দেখুন তার জরায়ুর অবস্থা। মনে রাখবেন, শিশু প্রসবের সময় মাতৃদেহের জরায়ুর ব্যাস স্বাভাবিক অবস্থা থেকে কয়েকগুণ বেড়ে যায়। নমনীয় হয়ে ওঠে অনেক বেশি।

প্রসবকালে বাচ্চার মাথা আগে বের হওয়ার কথা। যদি আগে মাথা না আসে তবে অবশ্যই অভিজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। আর যদি স্বাভাবিকভাবে বাচ্চা প্রসব হয়েই যায়, তবে হওয়ার পর বাচ্চার শরীর শুকানোর ব্যবস্থা করতে হবে। বাচ্চাকে রাখতে হবে উষ্ণ স্থানে।

এ সময় বাচ্চার পশ্চাদ্দেশ চাপড়ানো যাবে না। মুখ থেকে কোন তরল লালা জাতীয় কিছু বেরোলে তা প্রয়োজনে হাতের পরিস্কার আঙ্গুল দিয়ে বের করে আনতে হবে। বাচ্চার নাভির সঙ্গে সংযোগ নাড়িকে কয়েক ইঞ্চি ব্যবধানে কেটে পরিস্কার রজ্জু দিয়ে বেঁধে রাখতে হবে।

মনে রাখতে হবে, গর্ভাবস্থায়, প্রসবের সময় বা প্রসবের পর খুব বেশি রক্তস্রাব হওয়া, গর্ভফুল না পড়া- এগুলো ভালো লক্ষণ নয়। গর্ভাবস্থায় বা প্রসবের পর তিন দিনের বেশি জ্বর বা দুর্গন্ধযুক্ত স্রাব হলে, শরীরে পানি আসলে, খুব বেশি মাথা ব্যাথা, চোখে ঝাপসা দেখা দিলে, খিঁচুনী হলে, প্রসব ব্যথা ১২ ঘণ্টার বেশি স্থায়ী হলে অবশ্যই ডাক্তারের শরণাপন্ন হোন।

কিভাবে বহন করবেন আপনার চেয়ে ভারি কাউকে: কেউ আঘাত পেলে জরুরি মেডিক্যাল সাহায্য না আসা পর্যন্ত অন্য স্থানে না নেওয়াই ভালো। বিশেষ করে আক্রান্ত ব্যক্তি যদি মাথায়, ঘাড়ে কিংবা মেরুদণ্ডে আঘাত পান। এসব স্থান ছাড়া অন্য কোনো স্থানে আঘাত পেলে তাকে অধিকতর নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে।

আপনি যদি একা হন এবং বিষয়টি যদি এরকম হয় যে, আপনি যথেষ্ট শক্তিশালী নন, অথচ সে আপনার চেয়ে ভারি- এ ক্ষেত্রে তাকে বহন করা অনেক সময় কঠিন হয়ে ওঠে। তবে আপনি যদি কৌশলী হন তবে উদ্ধার হতে পারে কাজটি।

এ ক্ষেত্রে আপনাকে যা যা করতে হবে: মুখোমুখি তাকে এমনভাবে আপনার ঘাড়ে ওঠাতে হবে যাতে ওই ব্যক্তির কোমর থেকে ওপরের অংশ আপনার ডান কাধ থেকে পেছনের দিকে ঝুঁকে থাকে। আপনার ঘাড়ের দুই পাশ থেকে তার দুই বাহু এনে বাহুসহ আক্রান্ত ব্যক্তির দুই পা দুই হাত দিয়ে ধরুন।

অর্থাৎ লক্ষ রাখতে হবে তার শরীরের মাঝের অংশ আপনার কাঁধের ওপর পড়েছে কি না। পা আর পশ্চাদ্দেশে ভর করে সোজা হয়ে দাঁড়ান। এদিক ওদিক না ঝুঁকে সোজা হয়ে দাঁড়ান, নইলে পিঠে ব্যাথা পেতে পারেন। এভাবে আক্রান্ত ব্যক্তির পুরো শরীর আপনার কাঁধের ওপর নিয়ে হাঁটতে থাকুন।

ইন্টারনেট অবলম্বনে : খান মিজান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *